নারায়ণগঞ্জের সেভেন মার্ডার: আপিলে আটকে আছে ফাঁসির রায়

13

আবদুর রহিম: নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সেভেন মার্ডারের ঘটনার ৯ বছর অতিবাহিত হলেও আপিলে ঝুলে আছে ২৬ জনের ফাঁসির রায়। রায় কার্যকরের অপেক্ষায় রয়েছে নিহতদের স্বজন,বাদী এবং মামলার আইনজীবী

২০১৪ সালে এই নৃশংস এ ঘটনা ঘটে। এই হত্যাকন্ড গোটা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। সরকার দলীয় সাংসদ শামীম ওসমানের অনুসারী নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের দুই কাউন্সিলরের মধ্যে প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে এই হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটে।

২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল দুপুরে আদালত থেকে জামিন নিয়ে বাসায় ফেরার পথে অপহরণ এবং পরে হত্যাকান্ডের শিকার হয় নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের তৎকালীন প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, সহযোগী মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, লিটন, গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম, আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার ও তার গাড়িচালক ইব্রাহীম।

অপহরণের তিন দিনের মাথায় ৩০ এপ্রিল শীতলক্ষ্যায় ভেসে ওঠে সাতজনের মৃতদেহ। এ ঘটনায় নারায়ণগঞ্জ ছাপিয়ে আলোচিত হয় দেশব্যাপী। এই ঘটনার পর আলোচিত সাংসদ শামীম ওসমান এবং নূর হোসেনের মধ্যে মোবাইলে কথোপকথনের একটি অডিও বার্তা প্রকাশের পর নারায়ণগঞ্জের রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।  ঘটনার সাথে সাংসদ শামীম ওসমানের জড়িত থাকার বিষয়টি বেশ আলোচিত হয়। ঘটনার পরপরই মামলার প্রধান আসামী তৎকালীন সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর নূর হোসেন ভারতে পালিয়ে যায়। তাঁর পালিয়ে যাওয়ার পেছনে সাংসদ শামীম ওসমানের হাত ছিল বলেও সর্বোত্র চাউর হতে থাকে।

এ ঘটনায় নিহত অ্যাডভোকেট চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পাল ও নিহত নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি বাদী হয়ে ফতুল্লা মডেল থানায় পৃথক দুটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।

ঘটনার পরপরই ভারতে পালিয়ে গিয়ে আত্মগোপন করেন নূর হোসন। আত্মগোপনে  থাকাবস্থায় সেখানে গ্রেফতার হয়। দেশে ফিরিয়ে আনার পর বের হয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতে এই হত্যা মামলার রায়ের পর ২০১৮ সালের ২২ অগাস্ট ১৫ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে উচ্চ আদালত। অন্য আসামিদেরও বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়। কিন্তু, আপিলে গিয়ে ঝুলে আছে এই রায়।

বর্তমানে মামলাটি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে বলে জানিয়েছেন মামলার বাদী পক্ষের আইনজীবী এবং নগর বিএনপির আহবায়ক অ্যাডভোকেট শাখাওয়াত হোসেন খান।

চাঞ্চল্যকর সেভেন মার্ডার মামলায় তৎকালীন কাউন্সিলর নূর হোসেনসহ ২৬ জনের ফাঁসির আদেশ দেয় আদালত। এছাড়া বাকি ৯ আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এ মামলায় গ্রেপ্তার রয়েছেন ২৩ জন, পলাতক রয়েছেন ১২ জন।

ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন- নাসিকের সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন, র‌্যাব-১১-এর সাবেক অধিনায়ক লে. কর্নেল (অব.) তারেক সাঈদ মুহাম্মদ, মেজর (অব.) আরিফ হোসেন, লে. কমান্ডার (অব.) মাসুদ রানা, হাবিলদার এমদাদুল হক, আরওজি-১ আরিফ হোসেন, ল্যান্সনায়েক হীরা মিয়া, ল্যান্সনায়েক বেলাল হোসেন, সিপাহী আবু তৈয়্যব, কনস্টেবল শিহাব উদ্দিন, র‌্যাব সদস্য এসআই পূর্ণেন্দু বালা, সিপাহী সাদুজ্জামান নূর, নূর হোসেনের সহযোগী মোর্তুজা জামান চার্চিল, আলী মোহাম্মদ, মিজানুর রহমান দীপু, রহম আলী, আবুল বাশার, নূর হোসেনের সহযোগী ভারতে গ্রেপ্তার সেলিম, সানাউল্লাহ সানা, শাহজাহান, জামাল উদ্দিন, সৈনিক আবদুল আলীম, সৈনিক মহিউদ্দিন মুন্সী, সৈনিক আলামিন শরীফ, সৈনিক তাজুল ইসলাম ও সার্জেন্ট এনামুল কবির।

সাজাপ্রাপ্তরা হলেন- ল্যান্স কর্পোরাল রুহুল আমিন (১০ বছর), এএসআই বজলুর রহমান (৭ বছর), হাবিলদার নাসির উদ্দিন (৭ বছর), এএসআই আবুল কালাম আজাদ (১০ বছর), সিপাহী নুরুজ্জামান (১০ বছর), বাবুল হাসান (১০ বছর), র‌্যাবের সদস্য কর্পোরাল মোখলছুর রহমান (১০ বছর), এএসআই কামাল হোসেন (১০ বছর) ও কনস্টেবল হাবিবুর রহমান (১৭ বছর)।

মামলার বাদী নিহত নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি মামলার রায় দ্রুত কার্যকরের দাবি জানিয়ে বলেন,  আসামীরা সবাই প্রভাবশালী।  সিদ্ধিরগঞ্জের অপরাধ জগৎ  এখনো তাদের নিয়ন্ত্রণে। রায় হলেও এখনো কার্যকর হয়নি। কিসের জন্য অপেক্ষা, কার ইশারায় রায় কার্যকর থমকে আছে জানিনা, আমরা দ্রুত রায় কার্যকরের দাবি জানাচ্ছি।

বাদী পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান আপিলের দ্রুত নিষ্পত্তির দাবি জানিয়ে বলেন, রায়ের পর এভাবে বছরের পর বছর ধরে আসামিরা কারাগারে, অথচ রায় কার্যকর হচ্ছে না।

নিম্ন আদালতে এই মামলার রায় দ্রুত হলেও  নিম্ন আদালতে সাজার বিরুদ্ধে আসামিরা উচ্চ আদালতে আপিল করেছে। তবে আপিল বিভাগে মামলাটি দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে আছে। আমরা চাই, রায় বহাল রেখে মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তি করে এই মামলার রায় কার্যকর করা হোক।’

উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ আদালতে মামলায় হাজিরা দিয়ে ফেরার পথে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের ফতুল্লার লামাপাড়া এলাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র-২ নজরুল ইসলাম, তার সহযোগী মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, সিরাজুল ইসলাম লিটন, মনিরুজ্জামান স্বপনের গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম, আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার ও তার ব্যক্তিগত গাড়িচালক ইব্রাহিম অপহরণের শিকার হন। এর তিনদিন পর ৩০ এপ্রিল নজরুল ইসলামসহ ছয় জন ও ১ মে সিরাজুল ইসলাম লিটনের লাশ শীতলক্ষ্যা নদীর বন্দরের শান্তিরচর থেকে উদ্ধার করে পুলিশ।