সব দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করার ব্যাপারে সরকারের উপর চাপ বাড়ছে। এই নির্বাচন সরকার যতক্ষণ পর্যন্ত না করছে ততক্ষণ পর্যন্ত সরকারের উপর থেকে চাপ কমানো হবে না। এই চাপ বিরোধী রাজনৈতিক দল, জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের। পাশাপাশি ভোটাররাও চাইছেÑ তারা ভোট দিতে পারবে এমন একটা নির্বাচন হোক।
জাতীয় সংসদ নির্বাচন, তিনটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন, পৌরসভা নির্বাচন ও সব শেষে পৌরসভা নির্বাচন। এই সব নির্বাচনের ব্যাপারে নানা মহল থেকেই নিরপেক্ষ, অবাধ ও সুষ্ঠু না হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। তারপর সব দিকের চাপের কারণে সরকার নিজেও বুঝতে পারছেÑ নির্বাচন একটা করতে হবে। সেটা হবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ জন্য সরকারও এমন একটি নির্বাচন করতে চাইছে যে নির্বাচনটাকে আন্তর্জাতিক মহলের মেনে নিতে হবে যেÑ নির্বাচন সুষ্ঠুু, অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়েছে।
বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, আগামী নির্বাচনে বিএনপির র্শীষ নেতা যারা মামলার আসামি তারা যেন কেউ অংশ নিতে না পারেন সেই চেষ্টাও চলছে। সরকারের সব পরিকল্পনা ঠিক থাকলে আগামী ২০১৮ সালে একটি নির্বাচন হবে। ওই নির্বাচন কোন মাসে হবে তা এখনও ঠিক হয়নি। নিয়ম অনুযায়ী ২০১৯ সালের ৪ জানুয়ারির মধ্যে একাদশ সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। সংবিধান মতে সরকারের মেয়াদ পূর্তির তিন মাস আগে সরকার নির্বাচন করতে পারে। সেই হিসাবে সরকার ২০১৯ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত অপেক্ষা না করে আগামী ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে একটি নির্বাচন করার পরিকল্পনা নিয়েছে। সরকার মনে করছে, এতে আগাম নির্বাচনও করা হবে আবার ওই সময়ে নতুন নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচন হবে। এই কারণে নির্বাচন কমিশন নিয়ে যে বিতর্ক রয়েছে সেটা সরকারের সামনে থাকবে না। আন্তর্জাতিক মহলেরও চাপ থাকবে না। এমনভাবে নির্বাচন করা হবে যাতে সবাই মনে করে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। এ জন্য সরকার সব করবে।
বিশ্বস্ত সূত্র আরও জানায়, শেখ হাসিনার ইচ্ছে হচ্ছে আগামী ২০২১ সালে তিনি বাংলাদেশের ৫০তম বার্ষিকী উদযাপন করবেন তার সরকারের আমলে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী পালন করবেন। আওয়ামী লীগ এই দুই অনুষ্ঠানের পাশাপাশি দেশের উন্নয়নও করতে চাইছে। ২০১৮ সালে পদ্মাসেতু উদ্বোধন করতে চাইছে। এত সব কাজের সাফল্য কোনোভাবেই বিএনপিকে নেওয়ার সুযোগ দিতে চায় না আওয়ামী লীগ। এ জন্য আরও একটি মেয়াদের জন্য যেমন করেই হোক তাদেরকে ক্ষমতাসীন হতেই হবে। আরেক মেয়াদে ক্ষমতায় আসার জন্য যত ধরনের কৌশল করা দরকার সবই সরকার করবে। এখন যে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্রাথমিক কাজগুলো করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে সরকারে একজন দায়িত্বশীল মন্ত্রীও কাজ করছেন। তাকে বিশেষভাবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আইনিভাবে এমন ব্যবস্থা নিতে হবে যার ফলে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর একাধিক মামলায় কমপক্ষে দুই বছরের শাস্তি নিশ্চিত হয়। তারা কোনোভাবেই নির্বাচনে অংশ নেওয়ার যোগ্যতা না রাখেন। তাদের মামলা কেবল নিম্ন আদালতেই শেষ হলে হবে না, হাইকোর্টে ও আপিল বিভাগেও যেন মামলা শেষ করা যায় সেই হিসাবে তারা চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেছেন, তাদেরকে যে আমরা পরিকল্পিতভাবে নির্বাচনের বাইরে রাখার জন্য এগুলো করছিÑ বিষয়গুলো এমন নয়। তারা যে কৃতকর্ম করেছেন এর বিচার হওয়া প্রয়োজন। আর সেজন্য বিচার করতে হলে অবশ্যই তাদেরকে আইনের আওতায় আনতে হবে। সেটাই আমরা করছি। এমনতো নয় যে তারা অপরাধ করেনি। তারা তো অপরাধ করেছেন। যদি তারা অপরাধ না করে থাকেন তাহলে তারা আদালতে প্রমাণ করুক যে তারা অপরাধ করেননি। আইনের বিচারে তারা নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে এলে আমাদের কিছুই বলার থাকবে না। কিন্তু আমরা জানি তারা আইনের বিচারে নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করতে পারবেন না। এই কারণে তারা যতই চেষ্টা করুক না কেন তাদেরকে এই ব্যাপারে আইনের যে বিধান সেই বিধানে শাস্তি পেতেই হবে। জনগণ এটা দেখতে পাবে।
তিনি বলেন, আমরা তাদের প্রতি আক্রোশের বশে কোনো কাজ করছি না। বরং তারা জানে যে মামলা নিষ্পত্তি হলে তাদের শাস্তি হবে। এ জন্য তা ঠেকাতেও কালবিলম্ব করতে বার বার নানা আইনি পদক্ষেপ নিচ্ছে। এতে কোর্টের সময় নষ্ট হচ্ছে। এটা করে অপরাধ ঢাকা যাবে না।
এদিকে বিএনপির একটি ঘনিষ্ট সূত্র বলছে, বিএনপি চেয়ারপারসন, সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান, মহাসচিব, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিবÑ এরা অপরাধ না করলেও এদের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা করা হয়েছে। এই মামলাগুলো সরকার ইচ্ছা করেই করেছে। কারণ সরকার আবারও বিএনপিকে বাদ দিয়ে নির্বাচন করতে চাইছে। সরকারের পরিকল্পনা হচ্ছে বিএনপির সিনিয়র সবাইকে মাইনাস করে একটি নির্বাচন করা। তাদেরকে বাদ দিয়ে ও নির্বাচনের বাইরে রেখে অন্য যারা থাকবে তাদেরকে ম্যানেজ করে নির্বাচনে নেওয়া। ওই নির্বাচনে বিএনপিকে কয়েকটি আসন দিয়ে বিরোধী দলে রাখা। আর না হলে একটি দল হিসেবে কয়েকজন সংসদ সদস্য দিয়ে তাদেরকে সংসদে রাখা। যাতে তাদের বাইরে রাখার কারণে এখনকার মতো কোনো চাপে পড়তে না হয়।
বিএনপির প্রথম সারির কয়েকজনের শাস্তি সরকার নিশ্চিত করতে পারলে বিএনপি ক্ষমতাসীন হতেও পারবে না। আর এতে করে সরকার বিএনপিকে সংসদে রাখলে আন্তর্জাতিক মহলও কোনো চাপ দিতে পারবে না। কারণ তারা দেখবে যে দুর্নীতির কারণে তাদের শাস্তি হয়েছে। এতে আওয়ামী লীগের জন্য আগামী দিনে দেশ পরিচালনা করা সহজ হবে।
সূত্র জানায়, বিএনপি যতই চেষ্টা করুক আর আন্তর্জাতিক মহল যতই সরকারের ওপর, প্রধানমন্ত্রীর ওপর এবং আওয়ামী লীগের ওপর একটি আগাম নির্বাচন করার জন্য চাপ তৈরি করুক তাতে কোনো লাভ হবে না। কারণ এতে সরকার বা শেখ হাসিনা তার সিদ্ধান্তে কোনো পরিবর্তন করবেন না। তিনি তার পরিকল্পনামতো কাজ করবেন।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, আওয়ামী লীগ এবার ক্ষমতা হারালে আগামীতে ক্ষমতায় আসার সুযোগ অত্যন্ত ক্ষীণ বলে সরকার নির্যাতন-নিপীড়ন চালিয়ে ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। তবে ইতিহাসে কোনো স্বৈরশাসকদের ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। তিনি আরও বলেছেন, ৫ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচনের পর জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার মাধ্যমে শাসন ক্ষমতায় এসে বর্তমান ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করার অপচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।
তিনি বলেন, সরকারকে ষড়যন্ত্রের পথ পরিহার করতে হবে। আমাদের নামে মিথ্যা ও রাজনৈতিক যেসব মামলা দেওয়া হয়েছে এগুলো প্রত্যাহার করতে হবে। কারণ মানুষ বুঝতে পারছে সরকারের অবস্থা। সরকার এত পরিকল্পনা না করে সত্যিকার অর্থে একটি গ্রহণযোগ্য, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দিক আমরা ২০০’র বেশি আসন পেয়ে নির্বাচনে জয়ী হয়ে আসব। এটা সরকার জানে বলেই ভয় পায়। আর ভয় পায় বলেই ওই ধরনের একটি নির্বাচন দেবে না। আবারও তারা ৫ জানুয়ারির মতো একটি নির্বাচন করার চেষ্টা করবে। এবার হয়তো কৌশলে তারা কিছুটা ভিন্নতা আনবে। আগে তারা বিএনপিকে বাইরে রেখে যে ভুল করেছিল এবার হয়তো সেই ভুল করবে না। তবে বিএনপি ভাঙার যে ষড়যন্ত্র চলছে তা সফল হবে না। বিএনপি ভাঙা এত সহজ হবে না। এর আগে যারা এই চেষ্টা করেছে সবাই ব্যর্থ হয়েছে। বিএনপির ভেতরকার কোনো কোনো নেতাও বাইরে গিয়েছে। দল করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু সফল হতে পারেনি। সম্পাদনা : ইমরুল শাহেদ
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেছেন, সরকার নির্বাচন ব্যবস্থাকে এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছে এতে করে মানুষের মধ্যে ভোট না দেওয়ার প্রবণতা তৈরির চেষ্টা করছে। আর প্রার্থীদের মধ্যে বিনা ভোটে নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ তৈরি করছে। এই সংস্কৃতি আগামী দিনের জন্য ভালো হবে না। এখন যেভাবে চলছে এইভাবে তো চলতে পারে না। এখানে পরিবর্তন দরকার। বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আহমেদ আজম খান বলেন, সরকার আমাদের দুইশ’ নেতাকে আগামী নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করতে পারেন বলে আমাদের কাছে খবর রয়েছে। সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলেই হয়তো সরকার নির্বাচনের চিন্তা করবে। এই জন্য আমাদের নেতাদের নামে এত মামলা করা হচ্ছে।