আলোচিত জজ মিয়া এখন গাড়ি চালক!

47

ডেস্ক নিউজঃ  শোকগাঁথা একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার আলোচিত এক নাম জজ মিয়া। সে সময় সিআইডি’র সাজানো নাটকে গ্রেপ্তার হওয়া নোয়াখালীর আলোচিত সেই জজ মিয়া আজ সর্বহারা। নোয়াখালীর সেনবাগ কেশারপাড় ইউনিয়নের বীরকোট গ্রামের  টেন্ডল বাড়ির জালাল আহমদ জজ মিয়া দীর্ঘ কারাভোগের পর গ্রাম ছেড়েছেন। বর্তমানে নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকায় এক বস্তিতে বসবাস করছেন। জজ মিয়া বাঁচার তাগিদে মা আর ছোট বোনকে নিয়ে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে গাড়ির ড্রাইভার হিসেবে চাকরি করছিলেন। কিন্তু স্বল্প বেতনে তার পরিবার পরিজন নিয়ে জীবন যাপন করা কষ্টসাধ্য হওয়ায় চাকরি ছেড়ে দিয়ে বর্তমানে অন্যত্র চাকরির আশায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সারা দেশে জজ মিয়া আলোচিত হলেও এলাকায় বা আত্মীয়স্বজনদের কেউই তার পরিবারের খোঁজখবর জানেন না। বীরকোট গ্রামের মৃত আবদুর রশিদ ও জোবেদা খাতুনের ৪ ছেলে ১ মেয়ের মধ্যে জজ মিয়া দ্বিতীয়। প্রায় একযুগ আগে তার বাবা মারা যাওয়ার পর সামান্য পুুঁজি নিয়ে ঢাকার মতিঝিলে ফলের ব্যবসা করতেন জজ মিয়া। ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার ৯ মাস পর সেনবাগ থানার এএসআই কবির হোসেন গ্রাম পুলিশ মোকছুদ মিয়ার সহায়তায় বীরকোট গ্রামের রাজামিয়ার চা দোকান থেকে গ্রেপ্তার করে জজ মিয়াকে। পরে থানা থেকে জজ মিয়াকে সিআইডির এএসপি আবদুর রশিদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এর কয়েক দিনের মাথায় জজ মিয়া ২১শে আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনায় জড়িত বলে স্বীকারোক্তির খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। নানা নাটকীয়তার পর ২০০৮ সালের ১১ই জুন আদালতে সিআইডির দাখিল করা চার্জশিটে ২২ জনকে আসামি করা হলে অব্যাহতি দেয়া হয় জজ মিয়াকে। তখন জজ মিয়া মুক্তির বিষয়টি আটকে যায় ঢাকার সূত্রাপুর থানায় বিস্ফোরক আইনে দায়ের করা (১০৮, তাং- ২৭-১২-৯৮) মামলায়। এ মামলায় কোনদিন জজ মিয়াকে আদালতে হাজির না করা হলেও ২০০৫ সালের ২রা নভেম্বর আদালত তাকে ৭ বছরের কারাদণ্ডের আদেশ দেন। দীর্ঘ তদন্তের পর সিআইডি’র পক্ষ থেকে তখন বলা হয়েছিল জজ মিয়া ওই হামলায় জড়িত। যদিও তখনই এর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল বিভিন্ন মহলে। এর পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তদন্তের মূল রহস্য বেরিয়ে আসে। মামলা ভিন্নখাতে নেয়ার অভিযোগে তৎকালীন সিআইডির তিন তদন্ত কর্মকর্তা এএসপি আবদুর রশিদ, এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমান ও বিশেষ পুলিশ সুপার মো. রুহুল আমিনের বিরুদ্ধে সরকার মামলা করে। সেই সময়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের সঙ্গে অভিযুক্ত করা হয় তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরকে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে জজ মিয়ার বিরুদ্ধে পুলিশ চার্জশিট দিলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকার সময়ে তদন্ত শেষে চার্জশিট থেকে বাদ দেয়া হয় জজ মিয়াকে। দীর্ঘ ৪ বছর ২ মাস ২৫ দিন কারাভোগের পর ২০০৯ সালের ২০শে জুলাই কাশিমপুর কারাগার থেকে মুক্তি পান জজ মিয়া। কারামুক্তির পর ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে বীরকোট তার পৈতৃক বাড়িতে এসে আত্মীয়দের ঘরে উঠেন জজ মিয়া। কারণ মামলার ব্যয় বহন করতে গিয়ে ভিটেমাটিসহ সবকিছুই হারাতে হয়েছে জজ মিয়ার পরিবারকে। গত ২০শে আগস্ট রোববার জজ মিয়ার পৈত্রিক নিবাস বীরকোট গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বিক্রীত বসতঘরের দরজায় তালা ঝুলছে। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জজ মিয়া জেলে থাকা অবস্থায় তার পরিবার বসতবাড়ির জায়গাটুকু তার জেঠাত ভাই রফিক উল্যার কাছে বিক্রি করে দেয়। জজ মিয়ার মামলার সাক্ষী বীরকোট গ্রামের সাবেক মেম্বার বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তাফা চৌধুরী জানান, ২০০৪ সালের ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় জড়ানো জজ মিয়া ঘটনার দিন ও সময়ে তার বাড়ির পাশে বাবুলের দোকানে আমাদের সঙ্গে বসে চা খেতে খেতে টেলিভিশনের পর্দায় বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে ঘটে যাওয়া গ্রেনেড হামলার দৃশ্য দেখছিলেন। কিন্তু গ্রেনেড হামলা মামলায় তাকে জড়িয়ে তার পরিবারটিকে সর্বস্বান্ত করা হয়েছে। এর পর কেউই তার খোঁজখবর রাখেননি। তার মা জোবেদা বেগমের আবেদনের প্রেক্ষিতে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে গত ২৫ রমজান দু’লাখ টাকার চেক প্রদান করেন। জজ মিয়া ও তার পরিবারের দুঃখ-দুদর্শার কথা একে একে তুলে ধরলেন চায়ের দোকানদার বাবুল মিয়া, রাজা মিয়াসহ এলাকার শত শত নারী পুরুষ। এক আত্মীয়ের ফোনে জজ মিয়ার মাতা জোবেদা খাতুন কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, আমার নিরপরাধ ছেলেটিকে ধরে নিয়ে কত নাটক সাজাইছে। আমার পুরো পরিবারটিকে ধ্বংস করে দিয়েছে। বাড়িঘর বিক্রি করে দিতে হয়েছে। জোট সরকারের আমলে সর্বস্বান্ত হয়ে বর্তমান সরকারের নিকট একটু মাথা গোঁজার জায়গার জন্য বহু আবেদন করেছি। না পেয়ে বর্তমানে বস্তিতে বসবাস করছি। ছেলের ভবিষ্যৎ পথ চলা ও নিরাপত্তা নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করলেন মা জোবেদা। এদিকে বহুল আলোচিত জজ মিয়ার সঙ্গে আলাপ করলে তিনি জানান, আমাকে নিয়ে সিআইডির নাটকের কথা এদেশের মানুষ জানেন। মিথ্যা মামলায় পড়ে আমার জীবন থেকে গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলো চলে গেছে বলে হুঁ হুঁ করে কেঁদে ফেললেন জজ মিয়া। তিনি বলেন, আমি কখনো কোন রাজনীতি বা দলাদলিতে ছিলাম না। টুকিটাকি ব্যবসা করে কোনো রকম পরিবার পরিজন নিয়ে চলতাম। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় সিআইডি কর্মকর্তাদের সাজানো মামলায় আমাকে বলি করা হয়েছে। তাদের নাটকের বলি হয়ে দীর্ঘ সময় কারাভোগের পর বর্তমানে আমি নিঃস্ব। সরকারের কাছ থেকে একটু মাথা গোঁজার জায়গা ও জীবিকা নির্বাহের জন্য একটি চাকরি পেলে সংসার জীবনে পদার্পণ করে সুখী জীবন যাপন করতে পারবো।