কালবিলম্ব না করে আসুন আমরা সব ভেদাভেদ ভুলে দলমত নির্বিশেষে সন্ত্রাসবিরোধী ঐক্য গড়ে তুলি’ বলে আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া।
রবিবার বিকাল সোয়া ৪টায় গুলশানে নিজ রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এই আহ্বান জানান।
শুক্রবার রাতে গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্টেুরেস্টে সন্ত্রাসী হামলা এবং দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে বিএনপি। এর আগে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলের স্থায়ী কমিটির সাথে বৈঠক করেন খালেদা জিয়া।
খালেদা জিয়া বলেন, কে ক্ষমতায় থাকবে, কে ক্ষমতায় যাবে সেটা আজ বড় কথা নয়। আজ আমরা যারা আছি, আগামীতে হয়তো তারা কেউ থাকবে না। দেশ থাকবে, জাতি থাকবে। সেই দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ আজ বিপন্ন। তিনি বলেন, আমরা যে যাই বলি, যদি সন্ত্রাস দমন না করতে পারি। জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করতে পারি, তাহলে আমাদের কোনো অর্জনই টিকে থাকবে না।
খালেদা জিয়া বলেন, কাল বিলম্ব না করে আসুন আমরা সব ভেদাভেদ ভুলে, দলমত নির্বিশেষে সন্ত্রাসবিরোধী ঐক্য গড়ে তুলে শান্তিপূর্ণ নিরাপদ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তুলি।
খালেদা জিয়া বক্তব্যের শুরুতেই বলেন, গভীর বেদনাভরা মন নিয়ে আপনাদের (সাংবাদিক) সামনে এসেছি। আমাদের জাতীয় জীবনের এক মহা সঙ্কটের সময় এখন। গত শুক্রবার রাতে রাজধানী ঢাকায় এক ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছে। কূটনৈতিক এলাকার কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে আগ্নেয়াস্ত্র, গোলাবারুদ, গ্রেনেড ও বোমা নিয়ে সন্ত্রাসী দল ঢুকে পড়তে সক্ষম হয়। তারা গুলশানের ৭৯ নম্বর সড়কের একটি স্প্যানিশ রেস্তোরাঁয় ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে সেখানে অবস্থিত দেশী-বিদেশী নাগরিকদের জিম্মি করে।
তিনি বলেন, আইনশৃংখলা বাহনীর সদস্যরা উদ্ধার অভিয়ান চালাতে গেলে সন্ত্রাসীদের গুলি-বোমায় দুজন পুলিশ অফিসার নিহত ও অনেকে আহত হন। রাতেই সন্ত্রাসীরা তাদের হাতে জিম্মি দেশী-বিদেশী ২০ জন নিরপরাধ মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এই পৈশাচিক সন্ত্রাসী হামলা এবং নারীসহ দেশী-বিদেশী নির্দোষ নাগরিকদের এভাবে হত্যার ঘটনার নিন্দা করার কোনো ভাষা নেই। আমরা গভীর বেদনাহত এবং ক্ষুব্ধ। কোনো অজুহাতেই শান্তিপ্রিয় নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা সুস্থতার লক্ষণ নয়। এই বিকারগ্রস্ততার প্রতি আমরা তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করছি।
সঙ্কটের শেকড় আরো গভীরে উল্লেখ করে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, কেবল আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান দিয়ে এই সন্ত্রাস মোকাবিলা করা যাবে না। এই সঙ্কটের শেকড় আরো অনেক গভীরে। সন্ত্রাস দমন কার্যক্রমকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে গেলে এই সঙ্কট আরো প্রকট আকার ধারণ করবে। তিনি এই বিষয়টির দিকে সংশ্লিষ্ট সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সতেচন হবার আহ্বান জানান।
সন্ত্রাসবাদকে ভয়াবহ জাতীয় সঙ্কট আখ্যা দিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, ভৌগোলিক ও রাষ্ট্রীয় গন্ডি পেরিয়ে সন্ত্রাস আজ বিশ্বের দেশে দেশে রক্ত ঝরাচ্ছে। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিও আজ সন্ত্রাসের বিষাক্ত ছোবল জর্জরিত। এটা আমাদের জন্য নতুন এক ভয়াবহ জাতীয় সঙ্কট। শুক্রবার রাতের ঘটনায় শুধু একটি রেস্তোরাঁ নয়, সারা বাংলাদেশ আক্রান্ত হয়েছে। আক্রান্ত হয়েছে আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা, শান্তি, স্থিতিশীলতা, আমাদের বিশ্বাস ও আস্থা।
তিনি বলেন, আমাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, ব্যবস্যা-বাণিজ্য, জীবনযাপন পদ্ধতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এর সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তাই সবার মিলিত প্রয়াসে আমাদেরকে এ সঙ্কট মোকাবিলা করতে হবে।
বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, কোনো সুস্থ ও বিবেকবান মানুষ এধরনের কাপুরুষোচিত হামলা ও নিরপরাধ মানুষের হত্যাযজ্ঞকে মেনে নিতে পারে না। এমন অযৌক্তিক, নিষ্ঠুর, হঠকারী ও ভুল পথে কোনো কিছুই অর্জন করা সম্ভব নয়। কোনো আদর্শ কিংবা ধর্মই এ ধরণের কাণ্ডজ্ঞানহীন সন্ত্রাসী কার্যকলাপ অনুমোদন করে না। শান্তির ধর্ম পবিত্র ইসলাম নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা এবং সন্ত্রাসের ঘোর বিরোধী। তাই সংযম সাধনার মহিমান্বিত মাস রমজানে এই রক্তপাত প্রতিটি ধর্মপ্রাণ মুসলমানকে স্তম্ভিত করেছে।
খালেদা জিয়া বলেন, আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে গণতন্ত্রহীন দেশে, স্বৈরাচারী শাসন, অসহিষ্ণু রাজনীতি, দমন-পীড়নের রাষ্ট্রব্যবস্থা, অধিকারহীন সমাজ, আইনের শাসনের অনুপস্থিতি, অর্থনৈতিক বৈষম্য-বঞ্চনা এবং সুশিক্ষার অভাব ক্রমাগত চলতে থাকলে সেখানে সন্ত্রাসবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী পদক্ষেপের মাধ্যমে এই কারণগুলো দূর না করলে সমাজ থেকে সন্ত্রাস নির্মূল করা যায়না। আমি মনে করি জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়া এ ধরনের জাতীয় সঙ্কট মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। কেবল গণতান্ত্রিক পরিবেশই জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হতে পারে।
কোথায়ও কেউ নিরাপদ নয় উল্লেখ করে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই আতঙ্ক, এই হত্যালীলা থামাতে হবে। বন্ধ করতে হবে রক্তপাত। আমাদেরকে একতাবদ্ধ হতেই হবে। জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে।
তিনি বলেন, শুধু শুক্রবার রাতের ঘটনাই নয়। সারা বাংলাদেশ আজ সন্ত্রাসের থাবায় ক্ষতবিক্ষত। মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিন, মন্দিরের পুরোহিত, ধর্মগুরু ও যাজক, ভিন্ন মতের লেখক প্রকাশক-ব্লগার, খেটে-খাওয়া শ্রমজীবী মানুষদের নৃশংসভাবে হত্যা করা হচ্ছে। ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা আক্রান্ত হচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে আমাদের সংযত লালিত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহ্য।
তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ ও বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের সঙ্গে আমরাও শঙ্কিত। কারণ এই ঘটনায় আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতা ও ত্রুটি এবং সন্ত্রাসীদের সামর্থ প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে। আমরা এর আগে সন্ত্রাসীদের চোরাগোপ্তা হামলার সাথে পরিচিত ছিলাম। কিন্তু এখন তা আর চোরাগোপ্তা হামলার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। কারণ আমাদের এই শান্তিপ্রিয় মানুষের দেশে ভয়াবহ সন্ত্রাসের দানব গোপনে বেড়ে উঠেছে। তারা এখন পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে প্রকাশ্যেই ভয়ঙ্কর ছোবল হানছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাস্তবতাকে অস্বীকার করে পরিস্থিতিকে আরো অবনতির দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। দৃশ্যমান শত্রুর তুলনায় অদৃশ্য শত্রুর হামলা মোকাবিলা এবং তাদের দমন করা অনেক কঠিন। এই কথা জানি বলেই আমরা এতোটা উৎকণ্ঠিত।
খালেদা জিয়া বাংলাদেশ সেনাবাহীনিকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, শুক্রবার রাতের রক্তক্ষয়ী ঘটনার অবসান ঘটেছে শনিবার সকালে আমাদের সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে পরিচালিত কমান্ডো অভিযানের মাধ্যমে। এতে সন্ত্রাসীদের হত্যা, সন্দেহভাজন হিসেবে আটক এবং জিম্মি দশা থেকে ১৩ জন দেশী-বিদেশী নাগরিককে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা সাময়িক স্বস্তি পেয়েছি। এরজন্য আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিনের কাছে শুকরিয়া আদায় করছি। আমি সেনাবাহিনীকে ধন্যবাদ জানাই জাতীয় জীবনের এমন সঙ্কটে তাদের সামর্থ ও অনিবার্য প্রয়োজন আরেকবার প্রমাণ করার জন্য।
বিএনপি প্রধান বলেন, এই অভিযানে নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী পুলিশ, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন, সীমান্তরক্ষী বাহিনী, আইনশৃংখলা রক্ষাকারী অন্যান্য সংস্থা, অগ্নিনির্বাপক দল এবং গোয়েন্দা সংস্থা সমূহের যেসব সদস্য অসম সাহসিকতার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন আমি তাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি। ঝুঁকি নিয়ে সংবাদ সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত সাংবাদিকসহ কর্তব্যরত সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানাই।
এ ছাড়া পুলিশ বাহিনীর যে দুজন অফিসার উদ্ধার অভিযান চালাতে গিয়ে শুক্রবার রাতেই নিহত হন তাদের জন্য গভীর শোক প্রকাশ করেন বিএনপি চেয়ারপারসন দুজনের স্বজনদের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে তাদের রুহের মাগফিরাত কামনা করেন। এছাড়া যারা আহত হয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছেন, তাদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করেন খালেদা জিয়া।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়া বলেন, ইতালির নয়জন জাপানের সাতজন এবং ভারতীয় একজন নাগরিক সন্ত্রাসীদের হাতে নিষ্ঠুরভাবে অসহায় মৃত্যুর শিকার হয়েছেন। এই বিদেশী নাগরিকেরা পোশাক শিল্পের ক্রেতা হিসাবে এবং ব্যবসা, চাকরি ও পর্যটনের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে আসেন। তাদের জন্য গভীর শোক প্রকাশ করছি। তাদের নিজ নিজ পরিবার এবং ইতালি, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের সরকার এবং জনগণের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি। তাদের আত্মার শান্তি কামনা করছি।
তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশী নাগরিক তিন জন সম্ভবনাময় তরুণ-তরুণীকে হত্যা করেছে। তাদের রুহের মাগফিতার কামনা করছি। শোকাহত পরিবার বর্গের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি।
খালেদা জিয়া বলেন, এই বিপদের দিনে সহানুভূতি ও সহায়তার প্রস্তাব নিয়ে যেসব বন্ধু রাষ্ট্র বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছে, আমি তাদের ধন্যবাদ জানাই। আশা করি আমাদের রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা বজায় রেখে তারা সন্ত্রাস মোকাবিলায় সম্ভাব্য সকল ধরনের সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে। তবে নির্দিষ্ট ভূখন্ডে সন্ত্রাস মোকাবিলায় প্রথম কর্তব্য হচ্ছে সে দেশের সরকার ও জনগণের। বর্তমানে আমরা সন্ত্রাসের যে চিত্র দেখছি সেটা নিছক আইনশৃংখলা জনিত মামুলী কোনো সমস্যা নয়।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন- দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম, স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ স ম হান্নান শাহ, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বয় চন্দ্র রায় প্রমুখ।
প্রসঙ্গত, গত শুক্রবার রাতে গুলশানে হোটেল হলি আর্টিজান বেকারি রেস্তোরাঁয় সন্ত্রাসীদের হামলায় ২০ জন নিহত হয়। এর মধ্যে নয়জন ইতালিয়ান, সাতজন জাপানি, একজন ভারতীয়, একজন বাংলাদেশি আমেরিকান ও দুজন বাংলাদেশি রয়েছেন। এর আগে জিম্মিদের উদ্ধার প্রচেষ্টাকালে দুই পুলিশ কর্মকর্তা বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাহউদ্দিন খান ও গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার (এসি) রবিউল ইসলাম নিহত হন। পরে শনিবার সকালে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে অপারেশন থান্ডারবোল্টে ছয় সন্ত্রাসী নিহত হয় বলে তারা দাবি করেছে।