নিউজ প্রতিদিন: নব্বইয়ের দশকের পর থেকে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের যে বিস্ফোরণ শুরু হয়েছে তার পরিধি বাড়ছে৷ ৬৭৮টি সরকারি নথিভুক্ত পত্রিকা, ৭০টিরও বেশি রেডিও-টিভি চ্যানেল আর অগণিত অনলাইন পোর্টাল৷
সংখ্যার দিক থেকে বিস্ফোরণকে সমর্থন করে৷ কিন্তু বিপুল সংখ্যক গণমাধ্যমের সমাহার বাংলাদেশে দুই ‘ইজম’র (জার্নালিজম ও প্রফেশনালিজম) বিতর্ককে অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে৷ সম্প্রতি তরুণ সাংবাদিকদের পেশা ত্যাগ, সংবাদ প্রতিষ্ঠানগুলোতে অনিয়মিত বেতন-ভাতা, প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়া, স্বাধীন সাংবাদিকতায় নানামুখী চাপ ইত্যাদি কারণে পেশাসংশ্লিষ্টরা মনে করেন পেশার অবনমন ঘটেছে এবং ঘটছে৷ অনেককে হা-হুতাশ করে বলতে শোনা যায়, হিকি কিংবা কাঙাল হরিনাথের সময়, এমনকি খোদ স্বৈরশাসকের আমলেও সাংবাদিকতার এমন দুর্দিন ছিল না৷ অর্থাৎ বাংলাদেশে সাংবাদিকতায় পেশাদারিত্বের সঙ্কট উত্তরোত্তর বাড়ছে৷ এ আশঙ্কার বাণীটি সত্য বলে ধরে নিলে এককথায় এর উত্তর দেয়া কঠিন৷ বাংলাদেশের গণমাধ্যম ব্যবস্থা, এর পরিচালন ব্যবস্থা, রাষ্ট্র-সরকারের সাথে পেশাজীবীদের সম্পর্ক, সাংবাদিকতার মান৷ এমন অনেক বিষয়ের সাথে পেশাদারিত্বের সঙ্কটের বিষয়টি জড়িত৷
ডেনিয়েল সি. হালিন এবং পাওলো মানচিনি ২০০৪ সালে পশ্চিমের ১৮টি দেশের তুলনামূলক চিত্রের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যম ব্যবস্থার তিনটি মডেলের কথা বলেছেন৷ সেগুলো হলো- ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলোর সমবর্তিত বহুত্ববাদী মডেল, উত্তর/মধ্য ইউরোপের দেশগুলোর গণতান্ত্রিক কর্পেরেট মডেল এবং উত্তর আটলান্টিক দেশগুলোর উদারবাদী মডেল৷ আমাদের দেশের গণমাধ্যম ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যগুলোর সাথে প্রথম মডেলের মিল খুঁজে পাওয়া যায়৷ আটটি দেশের (স্পেন, ইটালি, ফ্রান্স, গ্রিস, পর্তুগাল, তুরস্ক, মাল্টা ও সাইপ্রাস) গণমাধ্যম ব্যবস্থা এই সমবর্তিত বহুত্ববাদী মডেলের অন্তর্ভুক্ত৷ এসব রাষ্ট্র ও তাদের গণমাধ্যম ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যগুলো হলো৷ এসব দেশে গণতন্ত্র এসেছে দেরিতে এবং দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সংঘাত বিদ্যমান ছিল, সংবাদপত্রের প্রচারসংখ্যা বা সার্কুলেশন কম, এডভোকেসি রিপোর্টিং ও মন্তব্যধর্মী সাংবাদিকতার সংস্কৃতি প্রবল, ব্যক্তি ও বেসরকারি মালিকাধীন গণমাধ্যমের সংখ্যা বেশি, রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার ও সম্প্রচার নীতিমালার রাজনীতিকরণ এবং একটি স্বাধীন পেশা হিসেবে সাংবাদিকতার বিকাশের গতি খুবই মন্থর৷
দক্ষিণ ইউরোপ এবং আফ্রিকার দেশগুলোর মত আমাদের দেশের সাংবাদিকতার সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ হলো রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমতি/লাইসন্সে প্রাপ্তি এবং কর্পোরেট স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে পরিচালনা নীতি৷ গুটিকয়েক ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের হাতে থাকা মালিকানা শুধু গণমাধ্যমের কাঠামো নির্ধারণ করে না, বরং আধেয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে৷ আমাদের গণমাধ্যমের সংবাদ কিংবা অনুষ্ঠান- উভয় ক্ষেত্রই দুটি বলয়ের মধ্যে আবদ্ধ৷ একটি বলয়ে আছে রাজনীতি, আরেকটি বলয়ে তিন ‘সি’- ক্রিকেট, ক্রাইম আর সিনেমা৷ কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নির্ভরতার কারণে সম্পাদকরা এখন ‘কর্পোরেট সম্পাদকীয় ব্যবস্থাপক’ আর সাংবাদিকেরা ‘কর্পোরেট সম্পাদকীয় কর্মকর্তা’৷ কর্পোরেট পলিসি আর সম্পাদকীয় নীতিতে ফারাক থাকছে না৷ সাংবাদিকরা কখনও সরকারি পাপেট, কখনও বহুজাতিক কোম্পানির পাপেট হিসেবে কাজ করে৷ পাঠক/দর্শকের কি জানা উচিত তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো বিজ্ঞাপনদাতা ও মালিকপক্ষ কি জানাতে চায়৷ সাথে যোগ হয়েছে অদৃশ্য নির্দেশনা বা টেলিফোনের ভয়৷ স্বৈরাচারী এরশাদের সময় মধ্যরাতের প্রেস এডভাইসে সংবাদপত্রের পৃষ্ঠাসজ্জা পাল্টে যেত৷ ২৪ ঘন্টার সংবাদের আমলে এই এডভাইস দিব্যলোকেই ঘটছে৷ ওয়ান ইলেভেনের পর থেকে দিন-দুপুরে এডভাইস দানের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে৷ রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে সেলফ-সেন্সরশিপের জন্ম হয়৷ ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপের কারণে সাংবাদিকদের মধ্যে যে ভয়ের সংস্কৃতি জন্ম নেয় তাতে সাংবাদিকরা অনুসন্ধানী রিপোর্ট করতে চান না৷
সাংবাদিকতার পেশাদারিত্বের সঙ্কটের এই প্রেক্ষাপটকে ধাক্কা দেয়ার জন্য দরকার শক্তিশালী আইনি কাঠামো ও সাংবাদিকদের ঐক্য৷ দু’টিই আমাদের দেশে বিরল৷ আমাদের সাংবাদিকদের সুরক্ষায় আইন না থাকলেও তাদের শেকল পরানোর মতো আইন ও নীতিমালার সংখ্যা অর্ধশতের কাছাকাছি৷ সবশেষ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাইবার অপরাধী ও সাংবাদিকদের একই কাতারে সামিল করার চেষ্টা পেশাদারিত্বে শৃংখল বাড়িয়েছে৷ সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার সংবাদপত্রগুলো দেখিয়েছে চাপকে ঠেকাতে নিজেদের মধ্যকার ঐক্য কতখানি জরুরি৷ কিন্তু বাংলাদেশে পেশাদারি সাংবাদিকতার জন্য ‘বিষফোঁড়া’র মত প্রতিবন্ধকতা হলো সাংবাদিকদের দলীয় লেজুড়বৃত্তি ও দলাদলি৷ জাতীয় প্রেসক্লাব থেকে শুরু করে সাংবাদিক ইউনিয়ন দু’ভাগে বিভক্ত৷ দলীয় লেজুড়বৃত্তির কারণে এডভোকেসি সাংবাদিকতার প্রবণতা ব্যাপক হারে বাড়ছে৷
এসব কারণে সাংবাদিকদের মধ্যে চাকরির সন্তুষ্টির হার প্রায় শূন্যের কোটায় পৌঁছেছে; অনেকেই অন্তর্বর্তীকালীন পেশা খুঁজছেন৷ সঙ্কট রাজধানীর চেয়ে মফস্বলেই বেশি৷ ফলশ্রুতিতে পেশায় দক্ষ ও যোগ্য কর্মীর অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে৷ উপরন্তু সাম্প্রতিক সময়ে গুজব বা মিথ্যা তথ্য দিয়ে সংবাদ পরিবেশন, তথ্যের বিকৃতি, সূত্র উল্লেখের ক্ষেত্রে অসঙ্গতি, তথ্য ও মতামতের মিশ্রণ, ভাষাগত ত্রুটি, সংবাদমূল্য নির্ধারণে পক্ষপাত, সংবাদের আদলে বিজ্ঞাপন৷ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে নৈতিকতার এসব মৌলিক জায়গাগুলোতে স্খলন বেড়েছে৷ এখনকার সাংবাদিকেরা সৃজনশীলতা এবং নৈতিকতার চাইতে ব্রেকিং নিউজ আর প্রেসের পাস-সুবিধা নেয়া কিংবা বিদেশ ভ্রমণের পিছনে দৌঁড়াতে বেশি আগ্রহী৷
বিষয়টি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, সাংবাদিকতা এখনও আমাদের কাছে ‘অকুপেশন’; এটি ‘প্রফেশন’ হয়ে উঠতে পারছে না৷ এই দু’য়ের মধ্যে বিদ্যমান পার্থক্য ক্ষীণ হতে পারে, কিন্তু খুব শক্তিশালী৷ যেমন চলছে তাতে জীবিকার জন্য সাংবাদিকতা একটি চাকরি হতে পারে৷ কিন্তু পেশা হিসেবে স্বীকৃতি পেতে হলে সত্যিকারের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে কাজ করতেই হবে৷