সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জঙ্গিদের হুমকি সম্বলিত বার্তা ছড়ানো হচ্ছে। আর এসব বার্তা ছড়ায় সহজে। স্বভাবতই আতঙ্ক ছড়ায় মানুষের মধ্যে। ভিডিও বার্তায় এরই মধ্যে হুমকি দেয়া হয়েছে হলি আর্টিজানের মত হামলা হতেই থাকবে বরং সেগুলো হবে আরও ভয়াবহ।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ইতিমধ্যে যথেষ্ট তৎপর হয়ে তল্লাশী অভিযান অব্যাহত রেখেছে। এসব হুমকি আমলে নিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামও নেতাকর্মীদের সতর্ক থাকতে বলেছেন। বলেছেন, খোলামেলা কিছু বলতে চান না তিনি, ইঙ্গিতই যথেষ্ট। আরও বলেছেন, নজর রাখতে হবে আরেকটি পঁচাত্তর যেন না হতে পারে। বাঙালি কেবল বীরের নয়, বেঈমানের জাতিও-সেই সতর্কতাও দিয়েছেন তিনি।
জঙ্গি হামলা মোকাবেলায় আওয়ামী লীগের তরফ থেকে জঙ্গিবিরোধী কমিটি গঠনের কথা বলার পর সেই কমিটি মাঠে ময়দানে কতটা সক্রিয় তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ইতিমধ্যে পুলিশের পক্ষ থেকে মন্ত্রীদের সতর্ক থাকার কথা বলা হয়েছে টেলিফোন ম্যাসেজ দিয়ে।
একই সঙ্গে সভা-সমাবেশ করে জনমত গঠনে ভূমিকা নেই মন্ত্রী-এমপিদের। তবে প্রশাসন সারা দেশে ব্যাপকভাবে তৎপর। পুলিশ প্রশাসনের পাশাপাশি সিভিল প্রশাসনও জঙ্গি দমনে কাজ করছে। অভিযানে অংশ নিচ্ছে অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থাও। প্রশাসনের ব্যাপক কার্যক্রমের পাশাপাশি রাজনৈতিক তৎপরতার পক্ষে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ থাকলেও কিছু কিছু জেলায় বিচ্ছিন্ন সভা-সমাবেশ করেছে ১৪ দল। পরিবারের কোনো নিখোঁজ ব্যক্তি থেকে থাকলে তার তালিকা করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
কিন্তু পরিকল্পিতভাবে জনমত গঠনে তেমন কোনো তৎপরতা নেই মন্ত্রী-এমপিদের। অনেকে ঈদেও যাননি এলাকায়, থেকেছেন ঢাকায়। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদবিরোধী রাজনৈতিক কমিটি গঠনে নেই মন্ত্রী-এমপিদের তেমন কোনো ভূমিকা। অনেক এমপি গ্রুপিংয়ের কারণে কমিটি গঠনের প্রক্রিয়ায় বাধাও সৃষ্টি করেছেন বলে জানা গেছে। কিন্তু আগামীকাল বৃহস্পতিবারের মধ্যে জেলা থেকে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত কমিটি গঠনে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ রয়েছে। খোদ ঢাকা মহানগরীতেই কোনো কমিটি গঠন করা হয়নি। ঢাকার অর্ধশতাধিক থানার মধ্যে মাত্র একটির কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা ও এমপিদের স্ব স্ব এলাকায় অবস্থান করে সন্ত্রাস প্রতিরোধ কমিটি গঠন ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি করতে বিশেষ নির্দেশনাও দেন তিনি। পরে জেলায় জেলায় পাঠানো মাহবুব-উল আলম হানিফ স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয় : জোটনেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ মোতাবেক দেশব্যাপী ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা এবং মহানগরে সন্ত্রাসবিরোধী কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই কমিটির অন্যতম কাজ হচ্ছে সন্ত্রাস, নৈরাজ্য ও জঙ্গিবাদী তৎপরতার বিরুদ্ধে জনগণকে সচেতন করা এবং তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। কিন্তু অধিকাংশ জেলা ও থানা পর্যায়ে কমিটি গঠন করা হয়নি।
রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও কেন্দ্রীয় নেতা এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘দলীয় সভানেত্রীর নির্দেশের পরই আমাদের কমিটি গঠনের কাজ শুরু করি। ইতিমধ্যে মহানগরে ১৪ দলের মূল কমিটি গঠন করা হয়েছে। এখন থানা ও ওয়ার্ড কমিটি গঠনের কাজ চলছে।’
হুমকির পর নিরাপত্তা জোরদার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কূটনীতিকপাড়ার নিরাপত্তায় সাধারণের প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত করা হয়েছে। মন্ত্রিপাড়াতেও ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না পরিচয় নিশ্চিত না হওয়ার আগে। সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীদেরকে এসএমএস করে সতর্ক করেছে খোদ পুলিশ। এর সত্যতা স্বীকার করে বিবিসিকে বেসামরিক বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেছেন, ‘জঙ্গি হামলা থেকে কেবলমাত্র নিরাপত্তা বাহিনী কাউকে রক্ষা করতে পারবে না। বরং জনগণকে নিয়েই জঙ্গি হামলা প্রতিরোধ করতে হবে’।
মন্ত্রিসভার সদস্যদের কাছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনারের পাঠানো সতর্ক বার্তা প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন ‘আমরা নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন নই, তবে সতর্ক আছি।’
সৈয়দ আশরাফ বলেছেন ‘পঁচাত্তরে আমরা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হারিয়েছি। সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেন আর না ঘটে। এ ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক করার দায়িত্ব আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের নিতে হবে।’
তিনি বলেছেন ‘স্বাধীনতার পরপর স্বাধীনতার স্থপতিকে পরিবার-পরিজনসহ হত্যা করার ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে নেই। ‘বাঙালি যেমন বীরের জাতি, তেমনি বেঈমানের জাতি। তাই আমাদের সজাগ থাকার প্রয়োজন আছে। মনে মনে প্রস্তুতি রাখারও প্রয়োজন আছে।’
গত মঙ্গলবার গণমাধ্যমে সৈয়দ আশরাফের বক্তব্যের পর দলের বিভিন্ন পর্যায়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। সৈয়দ আশরাফ কেন এসব কথা বললেন? কীসের ইঙ্গিত দিলেন? অশুভ কিছু কি ঘটতে যাচ্ছে? সরকার কি কিছু জেনেছে? তার পুরোটা কি জানাতে চাইছে না? না চাইলে কেন? আর পুরোটা জানাতে না চাইলে কেন এভাবে ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বললেন?-বোঝার চেষ্টা করছেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী আর শুভানুধ্যায়ীরা।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর একজন সদস্য বলেন, ‘সৈয়দ আশরাফের বক্তব্য নিয়ে অনেক ভেবেছি। কিন্তু দলের সাধারণ সম্পাদকের কথা নিয়ে মন্তব্য করা আমাকে মানায় না’।
দলের আরেক নেতা নূহ উল আলম লেলিন বলেন, ‘শেখ হাসিনাকে ২১ বার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। এখনও হয়ত কোনও চক্রান্ত চলছে। রাজনৈতিক অবস্থান থেকে হয়ত এ কথাই বোঝাতে চেয়েছেন সৈয়দ আশরাফ। তিনি হয়ত বোঝাতে চাইছেন আমরা বঙ্গবন্ধুকে হারিয়েছি, যেন শেখ হাসিনাকে হারাতে না হয়’।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো উপাচার্য (প্রশাসন) ও আওয়ামী লীগপন্থি নীল দলের শিক্ষক নেতা অধ্যাপক আখতারুজ্জামান একটি অনলাইকে বলেন, ‘আশরাফ সাহেবের পুরো বক্তব্যই আমি শুনেছি বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে তার এই কথাই খুবই গুরুত্ববহ। আমার কাছে মনে হয়েছে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরাপত্তার বিষয়ে কথা বলেছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আওয়ামী লীগ বিরোধী শক্তির হামলার লক্ষ্য একজনই। তিনি আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শত্রুরা এখনও তাকে সরিয়ে দিতে চায়। তাকে হারাতে পারলে আমরা সবাই হেরে যাবো। পুরো জাতির আর কাউকে কিছু করতে হবে না। আশরাফ সাহেব হয়ত এটাই বুঝাতে চেয়েছেন’।