ইউপি নির্বাচনে অযোগ্যরা পাচ্ছেন ধানের শীষ

97

ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন ঘিরে বিএনপির মনোনয়ন-বাণিজ্য অব্যাহত রয়েছে। তৃণমূল নেতাদের পাঠানো তালিকার নাম কেন্দ্রে এসে বদলে যাচ্ছে। কখনও দলীয় চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন পেয়ে যাচ্ছেন মাঠপর্যায়ের নিষ্ক্রিয় ও অযোগ্য নেতারাও। দলীয় নির্বাচনী প্রতীক ধানের শীষ চলে যাচ্ছে দলীয় পদ-পদবিবিহীন নেতাদের দখলে। এর পেছনে মোটা অঙ্কের টাকার লেনদেন মূল ভূমিকা পালন করছে বলে অভিযোগ করেছেন দলটির তৃণমূল নেতাকর্মীরা।

নির্বাচনী মৌসুমে বিএনপির প্রভাবশালী নেতারা এ সুযোগে চুটিয়ে বাণিজ্য করছেন। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন স্থানীয় কিছু নেতাও। সারাদেশে দল বেকায়দায় থাকলেও মনোনয়ন বাণিজ্যে লিপ্ত এসব নেতা এ ব্যাপারে নির্লিপ্ত এবং বেপরোয়া। অন্যদিকে এ নিয়ে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মধ্যে দিন দিন অসন্তোষ বাড়ছে। বিভিন্ন স্থানে সংবাদ সম্মেলন, মানববন্ধন, সমাবেশসহ বিক্ষোভ কর্মসূচিও পালন করছেন তারা। এমনকি দলীয় চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে মারামারির ঘটনাও ঘটে গেছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান মনোনয়ন বাণিজ্যের বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, এ বিষয়টি এখন রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। যতদিন পর্যন্ত রাজনীতি থেকে দুর্নীতিপরায়ণ ও দুর্নীতিগ্রস্তদের বের করা না যাবে ততদিন এ অবস্থা চলতেই থাকবে। দলীয় নেতাদের এ ধরনের কর্মকা-ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি-না জানতে চাইলে বিএনপির এ নেতা বলেন, দলের দায়িত্বশীল নেতারা মনোনয়ন বাণিজ্যের ব্যাপারে সচেতন। সময়-সুযোগ মতো অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

দলের স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ স ম হান্নান শাহ বলেছেন, ‘কিছু এলাকায় এসব ঘটছে বলে শুনেছি। তবে সরাসরি এ নিয়ে কেউ অভিযোগ করেননি। মূলত দলীয় প্রতীক যারা পাননি, তাদের কাছ থেকেই অভিযোগ আসছে। তবে সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগ পেলে দল অবশ্যই ব্যবস্থা নেবে।’

পদ-পদবিবিহীন নেতারাও পাচ্ছেন প্রতীক :তৃণমূল নেতাকর্মীদের অভিযোগ, সাংগঠনিক দুর্বলতা ও সরকারি নির্যাতন-নিপীড়নের কারণে এমনিতেই চলমান ইউপি নির্বাচনে সব জায়গাতেই দলীয় প্রার্থী দিতে পারেনি বিএনপি। এরপরও যে কয়েকটি জায়গায় মনোনয়ন দেওয়া সম্ভব হচ্ছে, সেগুলোতেও এ নিয়ে চলছে বাণিজ্য। স্থানীয় নেতারা দলীয় মনোনয়ন দেওয়ার কথা বলে মোটা অঙ্কের টাকা নিচ্ছেন। ফলে অনেক জায়গাতেই দলে পদ-পদবি কিংবা এলাকায় পরিচিতি নেইথ এমন ব্যক্তিরাও ধানের শীষ প্রতীকে চেয়ারম্যান প্রার্থী হচ্ছেন।

চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নে দলীয় প্রার্থী মনোয়ন নিয়ে এমন অভিযোগ উঠেছে দলের উত্তর জেলা কমিটির আহ্বায়ক আসলাম চৌধুরীর বিরুদ্ধে। গত ৭ মে অনুষ্ঠিত চতুর্থ ধাপে সন্দ্বীপের সারিকাইত, মাইটভাঙা, মগধরা, গাছুয়া, আমানউল্লাহ ও সন্তোষপুর ইউনিয়ন নির্বাচনে এই নেতার পছন্দের প্রার্থীরাই মনোনয়ন পান। নেতাকর্মীদের অভিযোগ, টাকার বিনিময়ে প্রার্থী চূড়ান্ত হওয়ায় নির্বাচনে তারা কেউই বিজয়ী হননি। এমনকি সবার জামানতও বাজেয়াপ্ত হয়েছে।

উত্তর জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ইঞ্জিনিয়ার বেলায়েত হোসেন এ প্রসঙ্গে সমকালকে বলেন, ‘দলের ত্যাগী নেতাকর্মীদের বাদ দিয়ে উত্তর জেলার নেতা মনোনয়ন বাণিজ্য করেছেন। সন্দ্বীপের ছয়টি ইউনিয়নে পছন্দের প্রার্থীকে মনোনয়ন দিয়েছেন তিনি। ভোটের পর দেখা গেছে, এদের কেউই ২০০ ভোটও পাননি।’

কেন্দ্রে এসে বদলে গেল প্রার্থীর নাম : ২৮ মে অনুষ্ঠেয় পঞ্চম ধাপের ইউপি নির্বাচনে নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার দীঘলিয়ার প্রার্থী হিসেবে ডা. ইউসুফ আলীর নাম কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু এখানে ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী করা হয়েছে শেখ রবিউল ইসলাম পলাশকে। অভিযোগ উঠেছে, প্রভাবশালী নেতারা অর্থের বিনিময়ে নাম বদলে দিয়েছেন। জেলার কয়েকজন নেতাও এর সঙ্গে জড়িত।

ডা. ইউসুফ আলী সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেন, প্রার্থী মনোনয়ন করেছেন তৃণমূল বিএনপির দুই স্তরের টিম। সে অনুযায়ী পঞ্চম ধাপের যে প্রার্থী তালিকা কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছিল, সেখানে তার নাম ছিল। অথচ তাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি।

বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলার চামরুল ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান ও বিএনপি নেতা সিরাজুল ইসলাম সাগর অভিযোগে বলেন, ‘তিনি ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান হলেও পঞ্চম ধাপের নির্বাচনে তার বদলে শাজাহান আলী নামে এক ইউপি সদস্যকে চেয়ারম্যান প্রার্থী করা হয়েছে। বিএনপির কেন্দ্রীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল মোমেন তালুকদার খোকা টাকা খেয়ে শাহজাহান আলীকে প্রার্থী করেছেন।’

তবে আবদুল মোমেন তালুকদার খোকা এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, ‘সাগর বিএনপির কেউ নন। তিনি যুবলীগের রাজনীতি করেন। তাকে বিএনপির মনোনয়ন দেওয়ার প্রশ্নই আসে না।’

চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে মারামারি :মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগে খোদ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে দলের দু’গ্র“পের মধ্যে মারামারির মতো অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটেছে। দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনাও হয়েছে।

ষষ্ঠ ধাপে অনুষ্ঠেয় ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার ১১টি ইউনিয়নে প্রার্থী চূড়ান্ত করতে কয়েক কোটি টাকার মনোনয়ন বাণিজ্য ও আত্মীয়করণের অভিযোগ রয়েছে। এ নিয়েই গত ৮ মে বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ের সামনে ভালুকা উপজেলা বিএনপির সভাপতি ফখরউদ্দিন আহাম্মেদ বাচ্চু ও উপজেলা যুবদল সভাপতি তারেক উল্লাহ চৌধুরীর সমর্থকদের সঙ্গে বিএনপি নেতা মোর্শেদ আলম গ্র“পের সংঘর্ষ হয়। এতে মজিবুর রহমান মজু নামের একজন নেতা আহত হন।

ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে মোর্শেদ আলম বলেন, ‘টাকার বিনিময়ে ফখরউদ্দিন আহাম্মেদ বাচ্চু জনপ্রিয় বর্তমান দলীয় চেয়ারম্যানদের বাদ দিয়ে ইচ্ছামতো তার পছন্দের লোকদের নাম কেন্দ্রে পাঠিয়েছেন। এ নিয়ে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে।’

তবে ফখরউদ্দিন আহাম্মেদ বাচ্চু অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ভালুকায় কোনো মনোনয়ন বাণিজ্য হয়েছে বলে তার জানা নেই। এ নিয়ে ঢাকার গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে ভালুকার বিএনপি নেতাদের মধ্যে শুধু তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। মারামারি হয়নি।