২৪ জনেরও বেশি নেতা বিএনপির রাজনীতিকে বিদায় জানাচ্ছেন

58

বিএনপির বহুল প্রত্যাশিত কমিটি গঠনের পর উচ্ছ্বাস প্রকাশের পরিবর্তে ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটেই চলেছে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমসহ সব পর্যায়ে চলছে কমিটি সম্পর্কে নেতিবাচক পর্যালোচনা। কমিটি ঘোষণার পর এরই মধ্যে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন নতুন কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান পদ পাওয়া মোসাদ্দেক আলী ও সহ প্রচার সম্পাদক শামীমুর রহমান শামীম। তবে বিএনপির জন্য আরো দু:সংবাদ হয়ে আসছে যা, তা হলো ক্ষুদ্ধ হয়ে ২৪ জনেরও বেশি নেতা বিএনপির রাজনীতিকে বিদায় জানাচ্ছেন। বিএনপির দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র এই ইঙ্গিত দিয়েছে। কমিটির সমালোচনা করে বিএনপির দায়িত্বশীল একাধিক নেতা বলেছেন, তাদের শঙ্কা কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার হাতে একক ক্ষমতা দেওয়া হলেও তাকে প্রভাবিত করে কমিটি গঠনের কাজ হয়েছে। কমিটি গঠনের আগ পর্যন্ত বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যদের কাছেও এ বিষয়ে তেমন তথ্য ছিলো না। তারা সবচেয়ে যে বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সেটি হচ্ছে, কমিটিতে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করা হয়েছে। অনেক জুনিয়র নেতা সিনিয়রের চেয়ে উপরের পদ পেয়েছেন। অনেকে আগের কমিটিতে যে পদে দায়িত্ব পালন করেছেন নতুন কমিটিতে তার চেয়ে নিচের পদ পেয়েছেন। এতে অনেকেই অপমান বোধ করছেন। তারা বলছেন, বিএনপির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় কমিটি ঘোষণা করেও কাউকে খুশি করা যায়নি। এটি একটি বড় কমিটি ঘোষণার পাশাপাশি বড় ধরণের ব্যর্থতাও। বড় কমিটি দিয়ে সবাইকে খুশি রাখার চেষ্টা করা হলেও বেশির ভাগ নেতারই ক্ষুব্ধ। আর ত্যাগীদের যথাযথ
মূল্যায়ন না হওয়ায় তৃণমূলের নেতা-কর্মীরাও হতাশ।
বিতর্কিত এই কমিটি দিয়ে ভবিষ্যতে সরকারবিরোধী আন্দোলন চালানো কঠিন হবে বলেও মনে করছেন তারা। এমনকি খালেদা জিয়ার ঘোষিত রূপকল্প ২০৩০-এর বাস্তবায়ন মুখ থুবড়ে পড়বে এই কমিটির জন্য।
বিএনপির সবচেয়ে প্রবীন নেতা শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন। যিনি আগের কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এই কমিটিতেও তিনি ভাইস চেয়ারম্যান পদে রয়েছেন। তবে তার প্রত্যাশা ছিলো বিএনপির সবচেয়ে সিনিয়র রাজনীতিবিদ হিসেবে তাকে দলের নীতি নির্ধারনী স্থায়ী কমিটিতে স্থান দেওয়া হবে। কিন্তু প্রত্যাশিত পদ না পেয়ে খুবই আশাহত হন তিনি। তার ঘনিষ্ঠজন ও ৯০ এর দশকের একজন ছাত্রনেতা জানিয়েছেন, ‘তিনি চরম অপমানিত বোধ করছেন। এ নিয়ে মনোকষ্টে গত দুইদিন তিনি হাসপাতালে ছিলেন। তার রক্তচাপ খুবই বেড়ে গেছে। অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তিনি। ইউনাইটডে হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে সোমবার তাকে বাসায় আনা হয়েছে।’
ওই ছাত্র নেতা বলেন, ‘শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সবচেয়ে প্রবীন রাজনীতিবিদ। আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ, আমির হোসেন আমু, বিএনপি নেতা মওদুদ আহমেদ তার অধীনে রাজনীতিতে এসেছেন। অথচ তিনি বিএনপির নীতি নির্ধারণী ফোরামে জায়গা পেলেন না। এ নিয়ে তিনি খুবই অপমান বোধ করেছেন। পদের লোভ করলে উনি কমিটি ঘোষণার পরই পদত্যাগ করতেন।’
দলের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, কমিটি গঠনের পর এতে নিজেদের পদ দেখে ক্ষুদ্ধ হওয়া নেতাদের মধ্যে আরো রয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমান (আগে যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন), ৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের আরেক নেতা ডাকসুর প্রাক্তন এজিএস ও বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য নাজিম উদ্দিন আলম (আগের কমিটির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক, চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা আবুল খায়ের ভূঁইয়া (আগের কমিটির সমাজকল্যাণ সম্পাদক), উপদেষ্টা মিজানুর রহমান মিনু, নির্বাহী সদস্য নাদিম মোস্তফা, উপদেষ্টা জয়নুল আবদীন ফারুক (আগের কমিটির প্রচার সম্পাদক), উপদেষ্টা আবদুস সালাম (আগের কমিটির অর্থনীতি বিষয়ক সম্পাদক), বিশেষ সম্পাদক ড. আসাদুজ্জামান রিপন (আগের কমিটির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক), নির্বাহী সদস্য ডা. মাজহারুল ইসলাম (আগের কমিটির স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক), কোনো পদেই নেই আবদুল লতিফ জনি (আগের কমিটির সহ দপ্তর সম্পাদক) প্রমুখ।
এছাড়া প্রত্যাশিত পদ পেয়ে ক্ষোভের তালিকায় রয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে (অব.) মাহবুবুর রহমান, ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান (আগের কমিটিতে ভাইস চেয়ারম্যান), ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা (আগের কমিটিতেও ভাইস চেয়ারম্যান), ভাইস চেয়ারম্যান শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন (আগের কমিটিতে ভাইস চেয়ারম্যান), আবদুল আউয়াল মিন্টু (আগের কমিটিতে উপদেষ্টা), অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন (আগের কমিটিতে উপদেষ্টা), ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমদ (আগের কমিটিতে ভাইস চেয়ারম্যান)। এদের মধ্যে কেউ রাজনীতি ছেড়ে দেওয়ার ও কেউ পদত্যাগের চিন্তাভাবনা করছেন এবং অনেকে নিস্ক্রিয় থাকার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।
জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, ‘কমিটি নিয়ে আর কি বলবো ? ভাবছি, কি করা যায়। এখনও কোনো সিদ্ধান্ত নেইনি। নেতাকর্মীরা আসছেন। আলোচনা করছেন। পরামর্শ দিচ্ছেন। কি করবো এখনও ঠিক করিনি।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটিতে লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমানকে আগের অবস্থান থেকে দুই ধাপ অবনমিত করা হয়েছে। স্থায়ী কমিটির দুই সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার এবং তরিকুল ইসলাম আগের কমিটিতে ক্রমানুযায়ী তার নিচে অবস্থান করলেও নতুন কমিটিতে তাদেরকে ওপরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এ নিয়ে আশাহত মাহবুবুর রহমান।
কমিটি নিয়ে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করতে গিয়ে দলের ক্রান্তিকালে দায়িত্ব পালন করা এই নেতা বলেন, ‘বিএনপির নতুন কমিটি নিয়ে সর্বস্তরে ক্ষোভ অভিযোগ আসছে। কারণ, এটা ঠিক যে, কমিটিতে অনেক ভুল এবং দুরদর্শিতার অভাব রয়েছে। জেষ্ঠ্যতা মানা হয়নি, সিনিয়রদের ওপরে জুনিয়রদের রাখা হয়েছে, যোগ্যতা অনুযায়ী মূল্যায়ন করা হয়নি। সর্বোপরি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দলের কাউন্সিলে ২০৩০ সালের যে রূপকল্প ঘোষণা করেছেন, এই কমিটি দিয়ে তা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।
স্থায়ী কমিটিতে তার দুই ধাপ অবনমনের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি আট বছর বিএনপির ক্রান্তিকালে দলের জন্য নিবেদিতভাবে কাজ করে গেছি। যখন কেউ ছিলো না সেই বিপদের দিনে আমি নিজে ছিলাম। নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে যখন আমার আরো ওপরে যাওয়ার কথা তখন আরো নিচে আসলাম।’
সেনাবাহিনীর প্রধান থাকা অবস্থায় নিজের ভূমিকার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বিএনপির এই নীতি নির্ধারক বলেন, ‘আমি স্থায়ী কমিটিতে আরো ওপরে যাওয়ার অধিকার রাখি। আমি দেশের সংবিধান রক্ষা করেছি, দেশকে গৃহযুদ্ধের হাত থেকে রক্ষা করেছি, সেনাবাহিনীর মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছি।’