বক্তাবলীর আল-আমিন ইকবালের প্রতারণার রিপোর্ট প্রকাশিত হল সিঙ্গাপুরের জাতীয় সংবাদ মাধ্যমে

920

মাশফীকুর রহমান শিশির: সামান্য নির্মান শ্রমিক থেকে হঠাৎ কোটিপতি বনে যাওয়া বক্তাবলী এলাকার রামনগর গ্রামের মো. আল-আমিন ইকবালের মালিকানাধীন এভারশাইন বহুমূখী সমবায় সমিতি লি. তথা এভারশাইন গ্রুপের দুর্নীতির রিপোর্ট প্রকাশিত হলো সিঙ্গাপুরের জাতীয় দৈনিক “দ্য স্ট্রেইট টাইমস” পত্রিকায়। “বাংলাদেশি শ্রমিকরা তাদের বিনিয়োগ নিয়ে দুশ্চিন্তায়” শিরোনামে পত্রিকাটিতে প্রকাশিত রিপোর্টে প্রতারণার বিষয়টি বিস্তারিত ওঠে এসেছে । “দ্য স্ট্রেইট টাইমস” পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট অবলম্বনে মো. আল আমিন ইকবালের দুর্নীতির বিস্তারিত পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল।

সিঙ্গাপুরে বেশ কিছু প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিক তাদের বিনিয়োগ নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় পড়েছেন। বিশ্বাস করে একটি ফার্মে তারা অর্থ বিনিয়োগ করেছিলেন কিন্তু সেখান থেকে এখন আর কোন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।

সিঙ্গাপুর প্রবাসী ২০ জন বাংলাদেশি শ্রমিকের অভিযোগ, তারা ২ লাখ সিঙ্গাপুরি ডলার যা বাংলাদেশি অর্থে ১ কোটি ২৪ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছেন। এভারশাইন গ্রুপ নামে একটি ফার্ম ঢাকায় ‘সিঙ্গাপুর সিটি’ নামে হাউজিং প্রতিষ্ঠা এবং বিভিন্ন প্রকল্পের কথা বলে এই টাকা নিয়েছে। তাদের অর্থ বিনিয়োগের সময় শেষ হয় গত বছরের শেষ দিকে। এরপর আর প্রতিশ্রুত অর্থ ফেরত পাওয়া যাচ্ছে না।

বিনিয়োগকারীরা সিঙ্গাপুরের দ্য স্ট্রেইট টাইমসকে জানিয়েছেন, স্থানীয় একটি হোটেলে ওই কোম্পানি একটি আবাসন মেলার আয়োজন করেছিল। তারা জানিয়েছিল, সিঙ্গাপুর ও ঢাকায় তাদের কার্যালয় রয়েছে। লিটল ইন্ডিয়ায় একটি রেস্টুরেন্টের ভবনের উপর তলায় কোম্পানিটির প্রধানের একটি দোকান ছিল। সেখানেই টাকা জমা দিত প্রবাসীরা।

দ্য স্ট্রেইট টাইমসের প্রতিবেদক অ চ্যাং উই’কে শ্রমিকরা জানান, তাদের বিনিয়োগের প্রসপেক্টাস, কাজের শিরোনাম এবং টাকা জমা দেওয়ার রশিদও তাদের কাছে রয়েছে।

৩৪ বছরের নাঈম সিঙ্গাপুরের একটি বাগানে মালির কাজ করেন। তিনি বলেন, ‘আমি ওই মালিককে বিশ্বাস করেছিলাম। গ্রাম থেকে রাজধানী ঢাকায় পরিবারকে স্থানান্তরের জন্যে আমার সব টাকা আমি বিনিয়োগ করেছিলাম।’

‘২০১২ সালে সিঙ্গাপুরের একটি হোটেলে আবাসন নিয়ে একটি রোড-শো অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে তার হাতে লিফলেট এবং অন্যান্য প্রচারপত্র ধরিয়ে দেওয়া হয়। যেখানে একটি নকশায় দেখানো হয় বড় একটি কমিউনিটি সেন্টার থাকবে। এমনকি মেরিলিয়নের মতো একটি ভাস্কর্যও থাকবে সেখানে।’

নির্মাণ শ্রমিক ৪২ বছরের রিফাতও একটি অংশে টাকা বিনিয়োগ করেন। তিনি বলেন, আমি আমার ভালোবাসার দেশে একটি জায়গায় থাকতে চেয়েছিলাম।

এই দুইজনই এভারশাইন বহুমূখী সমবায় সমিতিতে টাকা রাখেন। এখন অবশ্য বোঝা যাচ্ছে এই সমিতি অবৈধ। কারণ সিঙ্গাপুরের সংস্কৃতি, যোগাযোগ এবং যুব মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে এই প্রতিষ্ঠানের নাম পাওয়া যায়নি।
বিনিয়োগকারীরা জনপ্রতি ৬০০ সিঙ্গাপুরি ডলার থেকে ২ হাজার ৪০০ সিঙ্গাপুরি ডলার (৩৭ হাজার ২০০ টাকা থেকে ১ লাখ ৪৯ হাজার টাকা) পর্যন্ত ওই কোম্পানিকে দেন। এদের মধ্যে কয়েকজনকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তাদের এই মূলধন দুই বছরে দ্বিগুণ হয়ে যাবে। এভারশাইন গ্রুপে নাঈম ও রিফাত গত তিন বছর ধরে বিনিয়োগ করে আসছিলেন।

তবে সিঙ্গাপুরের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড কর্পোরেট রেগুলেটরি অথরিটির সঙ্গে এই কোম্পানির নাম যাচাই করে জানা যায়, এভারশাইন গ্রুপটি ২০১১ সালে নিবন্ধিত হয়েছিল। তবে, তিন বছর পর এই প্রতিষ্ঠানটি এভারশাইন ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানি হিসেবে নতুন নামকরণ হয় এবং মালিকানা পরিবর্তিত হয়। নতুন মালিক বলছেন, তাদের বিনিয়োগের মতো কোনো প্রকল্প নেই।

সিঙ্গাপুরের বাংলা ভাষাভাষীদের পত্রিকা ‘বাংলার কণ্ঠ’র সম্পাদক একেএম মহসিন বলেন, তিনি এই ধরনের অভিযোগ ২০০৯ সালের দিকে শুনেছিলেন। আবারও এমনটা ঘটলো। শ্রমিকরা চিন্তায় আছেন তাদের বহুল কষ্টে অর্জিত অর্থ ফেরত পাবেন কিনা।

বিনিয়োগকারী শ্রমিকরা বলছেন, গত কয়েক সপ্তাহ ধরে তারা এভারশাইন গ্রুপের মালিককে খুঁজে পাচ্ছেন না।তারা কয়েকজন স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেছেন। তবে কর্তৃপক্ষ বলছেন, সিঙ্গাপুরে বিদেশি সম্পত্তি বিক্রি অবৈধ কিছু নয়।

কয়েকজন শ্রমিক আশা করছেন, তারা তাদের বিনিয়োগ করা অর্থ হয়তো ফিরে পাবেন। কারণ কয়েকজন পেয়েছেন। নাঈম বলেন, কয়েকজন বেশ হৈ-চৈ করার পর ওই ফার্মের মালিকের কাছ থেকে অর্থ ফেরত পেয়েছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এভারশাইন গ্রুপের একজন সাবেক পরিচালক জানান, তিনি শ্রমিকদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করতেন এবং সেই অর্থ আবার ফেরত দেওয়ার কাজ করতেন। তিনি বলেন, মালিক আমাকে প্রতি রোববার সাড়ে তিন হাজার সিঙ্গাপুর ডলার (২ লাখ ১৭ হাজার টাকা) দিয়ে তার অফিসে বসাতেন মানুষকে টাকা ফেরত দেওয়ার জন্যে। আমি অনেককেই টাকা ফেরত দিয়েছি।

ফার্মের মালিককে খুঁজতে তার রেস্টুরেন্টে গিয়ে পাওয়া যায় নি। রেস্টুরেন্টের কর্মীরা বলেছেন, তাদের মালিক সিঙ্গাপুরেই রয়েছেন। তবে গত কয়েকদিন ধরে অফিসে আসছেন না।

বাংলাদেশ হাইকমিশনের একজন মুখপাত্র বলেন, আমরা শ্রমিকদের নিয়মিত মনে করিয়ে দিই তারা যেন সিঙ্গাপুরে থাকাকালিন এই দেশের নিয়ম মেনে চলেন। তাদেরকে অবৈধ সমবায় সমিতিতে বিনিয়োগ না করতে বলি। আমরা যখন ডরমেটরিগুলো পরিদর্শন করি তখনও একই কথা বলি।