একজন জাহাঙ্গীর ডালিমের গল্প – রাকিবুল রকি

63

মানিক বন্দোপাধ্যায় নিজের লেখার কারণ সম্পর্কে বলেছিলেন জীবন সম্পর্কে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করার জন্য তিনি লেখেন, যা বাংলা সাহিত্যে বলা হয়নি। প্রত্যেক লেখককেরই নিজস্ব কিছু কারণ থাকে লেখালেখির; কেউ লেখেন দায়বদ্ধতা থেকে কেউ পেশাগত কারণে কেউবা শখের বসে। এসময়ে তরুণ লেখক মোঃ জাহাঙ্গীর ডালিমের লেখালেখির শুরু শখ থেকে ইতোমধ্যে তা পেশায় পরিণত না হলেও নেশায় পরিণত হয়েছে প্রচন্ডভাবে। লিখছেন নিয়মিত। তার লেখা স্থানীয় পত্রিকা, জাতীয় পত্রিকাসহ বিভিন্ন সংকলনে প্রকাশিত হয়েছে এবং হচ্ছে। জাহাঙ্গীর ডালিম ১৯৮০ সালে ২২ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন। মা-সুফিয়া খাতুন বাবা মোঃ মাইজুদ্দিন আহম্মেদ। বাবা ডেইলিষ্টারে লেখালেখি করতেন। সেখানে থেকেই তিনি অনুপ্রাণিত হন লেখালেখির দিকে। জাহাঙ্গীর ডালিম দু’হাত ভরে কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, ফিচার লিখছেন। এগুলোর মধ্যে তার প্রতিভা একটু বেশি। জাহাঙ্গীর ডালিমের গল্পের বিষয় বহুমুখী, অন্যায়ভাবে যায় মানুষ। নানা দৃষ্টিভঙ্গী থেকে তিনি তুলে ধরেছেন মানুষের বিচিত্রমুখিতা। তাই সমাজ, সংসার রাজনীতি, প্রেম প্রকৃতি এই সবই তার গল্পের উপজীব্য। তিনি নষ্ট হয়ে যাওয়া মেধাবী ছেলের উত্থান যেমন রচনা করেন তেমনি দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের করুণ কাহিনী পরম মমতায় বিধৃত করেন। তার গল্পে না জানা ধর্ষিতা বোনের কথা যেমন আসে তেমনি উঠে আসে সর্বাঙ্গে লেগে থাকা মায়ের স্মৃতির কথা। আর শুক্কুর আলীর আয়না গল্পে যুদ্ধাহত শুক্কুর আলীর প্রতীকের মাধ্যমে উঠে এসেছে সকল নিপীড়িত, লাঞ্চিত মানবেতর জীবন যাপনকারী যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের বর্তমান অবস্থা। গল্পে এক পঙ্গু ভিক্ষুক মুক্তিযোদ্ধা দোকানে গিয়ে একটা আয়নায় চান নিজের অবয়ব দেখার জন্য। কারণ কিছুক্ষণ আগে রাস্তা পাড় হতে গিয়ে এক বিলাস বহুল গাড়ির বনেটের উপর পড়ে গেলে গাড়ির চাক্যচিক্য নষ্ট হওয়ায় গাড়ির মালিক তাকে কুত্তার বাচ্চা বলে গালি দেয়। সাথে সাথে তলপেটে একটি লাথি বসিয়ে দেয়। তাতে শুক্কুর আলী বেশ কিছুক্ষণ রাস্তায় পড়ে থাকলেও কেউ তাকে তুলতেও আসে না। তাই শুক্কুর আলী দোকানে এসেছেন তিনি মানুষ না সত্যিই কুত্তার বাচ্চা তা আয়নায় দেখতে কিন্তু আয়নায় মানুষের অবয়ব ফুটে উঠলেও শুক্কুর আলী বুঝে যান আসলে দেখতে মানুষের মতো হলেও তিনি তো কুত্তার বাচ্চার মতোই বেঁচে আছেন। এভাবে জাহাঙ্গীর ডালিম নিপুন হাতে সমাজের অবক্ষয় বৈষম্য তুলে ধরেন, যারা জীবনকে বাজী রেখে দেশ স্বাধীন করেছিল তাদেরই একজন শুক্কুর আলীকে স্বাধীন দেশে অত্যন্ত আক্ষেপের সাথে বলতে শুনি ‘ইস একাত্তরে গুলিটা যদি পায়ে না বিঁধে বুকে এসে বিঁধত।

‘বটের পাতায় কাফন’ গল্পে প্রকৃতির সাথে মানুষের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কে কথা তুলে ধরেছেন তিনি। বৃদ্ধ হাসমত আলী যার বউ মারা গেছে অনেক আগে দু ছেলে এক ছেলে হারিয়ে গেছে। মারা গেছে অন্য ছেলে। যার কেউ নেই চেয়ে কোনদিন খাবার জোটে কোনদিন বা উপবাসে কাটে। সেই অথর্ব প্রদান যখন প্রাচীন বট গাছের তলায় এসে হাজির হয় পরিতৃপ্তিতে ভরে উঠে তার মন।

সারাদিন সে বটের তায় কাটিয়ে দেয়। সেখান দিয়ে কেউ যাবার সময় শুনতে না চাইলেও হাসমত আলী সাগ্রহে শোনায় বটের জীবন কথা। হাসমত আলীর দাদার দাদার দাদা যখন বালক তখন এই বট ছিল কবি চারা। এ বটন যেন আজ তার পরিবরেই কেউ। তাই রাস্তা বড় করার জন্য যখন এই প্রাচীন বট গাছ কাটার কথা উঠে প্রথম বিশ্বাস করতে পারল না বৃদ্ধ হাসমত। মানুষ কি এত বিশ্বাস ঘাতক হতে পারে কখনও হতে পারে এত অকৃতজ্ঞ? কিন্তু একদিন এসে যখন দেখে বটগাছ নেই পড়ে আছে ঝরাপাতা, ডালপালা, বৃদ্ধ বুক ফাটা আর্তনাদ করে উঠে, গ্রামে যারা বৃদ্ধের বউ মারা যেতে দেখেছে, সন্তান মারা যেতে দেখেছে তখনও এভাবে তাকে কেউ কাঁদতে দেখেনি। গাছের শোকে সেখানেই সে প্রাণ ত্যাগ করে। বটের পাতায় তার সারা শরীর কাফনে মতন ঢেকে যায়। লোকে বলাবলি করতে থাকে ‘বটগাছ পাগল বুড়োটা গাছটার সঙ্গে সঙ্গে মরে গেল। জাহাঙ্গীর ডালিম এভাবে গাছের সাথে মানুষের যেসব নিবিড় সম্পর্ক গাছ নির্মূল হলে যে প্রাণীকুল সত্যিই বিপন্ন হয়ে পড়বে সেই কঠিন সত্যই তুলে ধরেছেন। জাহাঙ্গীর ডালিমের ভাষা চিত্রময়, তিনি ছোট বাক্যের চিত্র ফুটিয়ে তোলেন। তার গদ্য কাব্য ধর্মী। ‘মায়ের কাছে পত্র’ গল্পে মৃত মাকে উদ্দেশ্য করে যখন লেখেন- ‘ঠিক যখন মধ্য দুপুরে প্রচন্ড রোদে পথিকের মাথা ফেটে যেতে চাইবে কাকগুলো তৃষ্ণায় ছটফট করতে থাকবে। এলাকার কুকুরগুলো ডেকে ডেকে ক্লান্ত হয়ে যাবে, দুষ্ট ছেলেরা চুপটি করে ঘুমিয়ে পড়বে যখন আর সেই আইসক্রিম অলাটা আইসক্রিম আইসক্রিম বলে চেঁচাবে তখন আমি তোমার কাছে এক টাকা চাইব, তুমি দেবেতো মা আমায় ? তখন তা গল্পের বক্তব্যকে যেমন জোরালো করে তেমনি পাঠকের মনে কাব্যিক ব্যঞ্জনাও ছড়িয়ে দেয়। জাহাঙ্গীর ডালিমের গল্প সংলাপ ধর্মীয় নয় বক্তব্যধর্মী। বর্ণনার মাধ্যমে তা গল্পে পরিণতির দিকে এগিয়ে যায়। এভাবেই তার গল্প পাঠক প্রিয়তা পেয়েছে। তারপরেও বলব গল্প, উপন্যাস বা নাটকে সংলাপ অপরিহার্য। তাই এদিকে তার খেয়াল রাখা দরকার। দরকার তার ক্ষুদ্রায়তনের গল্পগুলোর পরিসর আরেকটু বাড়ানো। জাহাঙ্গীর ডালিম তরুণ তার সামনে পড়ে আছে বিশাল পথ। তাই তার উচিত এখনি নিজেকে নির্দিষ্ট কর্মে আবদ্ধ না করে নিরীক্ষা প্রবণ হওয়া তাতে তার সাথে সাথে পাঠকেরারও উপকৃত হবে। জাহাঙ্গীর ডালিমের অন্য যেসব গল্প তার পরিচিতির পরিধি বাড়িয়ে দিয়েছে সেগুলোর মধ্যে কয়েকটি হলো- পাপমুক্তি, মানুষ এবং মানুষের কাহিনী, রাত প্রহরের øিগ্ধতা, বিবর্জিত রাত্রি যাপন, সুখ শুধুই সখ, মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে প্রভৃতি। তার উপরিউক্ত গল্পগুলো বাংলাসাহিত্যের সেরা গল্পের সমপর্যায়ের না হলেও তাকে সুদূরের অভিযাত্রি হিসেবে সহজেই চিনিয়ে দেয়। এই গল্পগুলো সেই বৈশিষ্ট্য বহন করে। এবারের বই মেলায় তার একটি কবিতার বই “বৃষ্টি ভেজা কবিতা” বইটি মেলাতে এবং দেশ বিদেশে বেশ সাড়া পড়ে। যুগান্তর স্বজন সমাবেশের সভাপতি জাহাঙ্গীর ডালিমের ২২ জুলাই জন্মদিন। এই জন্মদিনে স্বজনদের পক্ষ থেকে তার প্রতি রইল আন্তরিক ফুলেল শুভেচ্ছা।