পায়ুপথে বাতাস ঢোকানোর পর মিলের কর্মচারি ও শ্রমিকরা শিশু সাগরকে স্থানীয় একটি ক্লিনিকে নিয়ে যায়। মিলের বেশ কয়েকটি গাড়ি থাকলেও মূমূর্ষ সাগরকে হাসপাতালে পাঠানো হয় রিক্সায়। ক্লিনিক থেকে সাগরকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলে। কিন্তু সেখান থেকে তাকে সরাসরি ঢাকা মেডিক্যালে না নিয়ে আবার আনা হয় মিলে। এমন অমানবিক আচরনের শিকার হয়ে পরপারে চলে যায় সাগর। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় মিলের এমডি লায়ন মোজাম্মেল হক, তিন ডিরেক্টর, চারজন কর্মকর্তার নাম উল্লেখসহ মোট দশজনকে আসামী করা হয়েছে। পুলিশ গ্রেফতার করেছে প্রশাসনিক কর্মকর্তা নাজমুলকে। মিলে মারপিট গালিগালাজের প্রতিবাদ করায় মিলের কোন কর্মকর্তা অন্যদের সহযোগিতায় এ ঘটনা ঘটিয়ে বলে অভিযোগ করেছে নিহতের পরিবার।
রুপগঞ্জ থানায় শিশু সাগরের বাবা রতন বর্মণ বাদি হয়ে এ মামলা দায়ের করেন। মামলায় রতন বর্মণ বলেন, আমি ও আমার নয় বছর বয়েসি ছেলে সাগর বর্মণ সাত মাস ধরে রুপগঞ্জ থানার যাত্রামুড়াস্থ জবেদা টেক্সটাইল এর ৫ নং ইউনিটে সকাল ছয়টা থেকে দুপুর দুইটা পর্যন্ত কাজ করি। গত ২৪ জুলাই দুপুর বারোটায় আমার ছেলে সাগর অন্যান্য দিনের মতো কাজ শেষ করে শরির থেকে তুলা ও ধুলাবালি পরিস্কার করার জন্য হাওয়া মেশিনের সামনে যায়। একটু পরেই একজন মহিলা ঝাড়–দার আমার কাছে এসে বলে যে আমার ছেলে মাটিতে গড়াগড়ি যাচ্ছে। তার পেট ফুলে গেছে। কথা বলতে পারছে না। আমি দৌড়ে গিয়ে দেখি সবাই মিলে আমার ছেলেকে অফিসে নিয়ে গেছে। তখন অফিসের লোকজন আমার ছেলেকে রিক্সায় উঠিয়ে কাচপুরে একটি হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিন্তু এ হাসপাতালে আমার ছেলের চিকিৎসা হবেনা বলে ডাক্তার জানিয়ে দেয়। ফলে তারা আমার ছেলেকে আবার ফ্যাক্টরিতে আনে। আমার ছেলের অবস্থা দেখে আমি কান্নাকাটি করতে থাকলে প্রতিষ্ঠানের লোকজন ছেলেকে ও আমাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। তখন হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক আমার ছেলেকে মৃত ঘোষনা করে।
মামলায় সাগরের বাবা আরো বলেন, প্রতিদিন এই ফ্যাক্টরির এডমিন নাজমুল হুদা, উৎপাদন ম্যানেজার মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ, সিনিয়র উৎপাদন অফিসার আজহার ইমাম সোহেল, সহকারি উৎপাদন ম্যানেজার রাশেদুল ইসলামসহ অজ্ঞাতনামা তিন-চারজন লাইনম্যান, সুপারভাইজার প্রায়ই কাজকর্মের সামান্য ত্রুটি পেলে আমাকে ও আমার ছেলে সাগরকে মারপিট ও গালিগালাজ করতো। আমার ছেলে মাঝে মধ্যে এর প্রতিবাদ করতো। যার কারনে উল্লেখিতরাসহ আরো তিন-চারজন শ্রমিক ২৪ জুলাই বেলা সাড়ে বারোটায় হাওয়া মেশিনের পাইপ আমার ছেলের পায়ুপথে ঢুকিয়ে তাকে হত্যা করেছে।
সাগরের বাবা এ হত্যাকান্ডের জন্য মিলের মালিকদেরও দায়ি করেন। মামলার এজাহারে তিনি বলেন, মিলের এমডি মোজাম্মেল হক ভূইয়া, ডিরেক্টর মাজহারুল ইসলাম ভূইয়া, আজহারুল হক ভূইয়া, জাফর হোসেন ভূইয়া এই কারখানায় শিশু শ্রমিক নিয়োগ দিয়ে কম বেতনে কারখানার উৎপাদন কাজ করে আসছেন। এই মালিকরা ঘটনাস্থলের হাওয়া মেশিন রক্ষনাবেক্ষন বা পরিচালনার জন্য দক্ষ অফিসার বা কর্মচারি নিয়োগ করলে আমার ছেলে সাগরের এমন করুন মৃত্যু হতো না।
তবে মামলার প্রাথমিক তথ্য বিবরনিতে পুলিশ চার মালিকের নাম লেখেনি। নারায়ণগঞ্জের বিশিষ্ট আইনজীবি ও বাংলাদেশ টেক্সটাইল গার্মেন্ট শ্রমিক ফেডারেশন এর সভাপতি এডভোকেট মাহবুবুর রহমান ইসমাইল জানান, পুলিশ প্রাথমিক তথ্য বিবরনিতে চার মালিকের নাম আসামীর তালিকায় লেখেনি। হয়তো পুলিশ এখানে মালিকদের পক্ষে অবস্থান নেয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু এতে লাভ হবেনা। কারন এজাহারে তাদের নাম আছে। এবং তারা এর মধ্যেই মামলার আসামী হয়ে গেছেন। ঘটনার প্রতিবাদে সোমবার সকালে তার নেতৃত্বে নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের সামনে একটি মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। এখানে বক্তব্যে তিনি বলেন, টাকা ছড়িয়ে মিলের মালিক মোজাম্মেল হক বিষয়টিকে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করছেন।
এ ব্যাপারে রুপগঞ্জ থানার ওসি ইসমাইল হোসেনের মোবাইল ফোনে বেশ কয়েকবার ফোন দিলেও তিনি ধরেননি।
যোগাযোগ করা হলে বড় ভাই রিপনের স্ত্রী অঞ্জনা জানান, সাগরকে প্রায়ই কারখানার কর্মকর্তারা নির্যাতন করতো। দুই মাস আগে বারি দিয়ে তার মাথা ফাটিয়ে ফেলে তারা। নির্যাতনের প্রতিবাদ করার কারনেই সাগরকে এমন নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে বলে তারা মনে করছেন।
সাগরের বাবা রতন বর্মন জানান, ঘটনার পরপর মিলের গাড়ি দিয়ে যদি ছেলেকে ঢাকায় পাঠাতো তাহলে হয়তো সে বেঁচে যেতো। মিলের অনেক গাড়ি থাকলেও আমার ছেলেকে হাসাপাতালে পাঠানো হয় রিক্সা দিয়ে। পরে ঢাকায় পাঠানো হয় সিএনজি দিয়ে।
অন্যদিকে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মহিবুল ইসলাম (প্রশাসন) জানান, সোমবার দুপুরে অভিযান চালিয়ে এ মিল থেকে ২৭ জন শিশু শ্রমিককে উদ্ধার করে তাদের পরিবারের কাছে দিয়ে দেয় পুলিশ। এ ঘটনায় মামলার প্রেক্ষিতে মিলের প্রশাসনিক কর্মকর্তা নাজমুল হুদাকে গ্রেফতার করে আদালতে পাঠানো হলে আদালত সাতদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন।
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে রূপগঞ্জের যাত্রামুড়া এলাকায় অবস্থিত জোবেদা সাইজিং এন্ড স্পিনিং মিলে রোববার দুপুরে কাজ করার সময় কয়েকজন লোক সাগর বর্মনের পায়ুপথে মেশিন দিয়ে বাতাস ঢুকিয়ে হত্যা করে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতলে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। নিহত শিশুটি নেত্রকোনা জেলার খালিয়াজুড়ি উপজেলার রাজিবপুর গ্রামের রতন বর্মণের ছেলে। তারা বর্তমানে কারখানার পাশেই বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করে। তিন ভাইয়ের মধ্যে সাগর ছোট।
ঘটনার প্রতিবাদে বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিবাদ
এ ঘটনার ঘাতকদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবি জানিয়েছে সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চ। সোমবার দুপুরে মঞ্চের আহবায়ক রফিউর রাব্বি ও সদস্য সচিব হালিম আজাদ স্বাক্ষরিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত বছর খুলনায় ১২ বছরের রাকিবকে ঠিক একইভাবে পায়ুপথে কমপ্রেসার দিয়ে বাতাস ঢুকিয়ে তার নাড়ীভুঁড়ি ছিন্ন ভিন্ন করে হত্যা করা হয়েছিল। এসব হত্যাকান্ড সমাজের নৈতিক-ধস ও মানবিক মূল্যবোধ থেকে ক্রমাগত দূরে সরে যাওয়ারই বহিঃপ্রকাশ, সমাজে কতিপয় বিকারগ্রস্থ ব্যক্তির বিকৃত মানসিকতার ফল। সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা মানুষকে আজ কতটা হিংস্র করে তুলেছে এ সবই তার প্রমান। খুলনার রাকিব হত্যার বিচার তিন মাসের মধ্যে সম্পন্ন করে সরকার একটি নজির স্থাপন করেছিল; আমরা চাই সাগর হত্যার বিচারও তেমনি দ্রুত সম্পন্ন করা হবে।
সাগর বর্মণের হত্যাকারীদের অবিলম্বে গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবী জানিয়েছে বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি। সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতা আবু হাসান টিপু এক বিবৃতিতে বলেন, কোন অজুহাতেই এই মানুষরূপী নরঘাতকরা যেন ছাড় পেয়ে না যায় সেদিকে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে খেয়াল রাখতে হবে।