ষোড়শ সংশোধনী রায়ের পর্যবেক্ষণ সঠিক নয়-ড. এনায়েতুল্লাহ আব্বাসী

94

গত ১লা আগষ্ট ২০১৭ইং তারিখে প্রধান বিচারপতি এস.কে সিনহা ষোড়শ সংশোধনী রায় দিয়েছেন । রায়টি ছিল মূলতঃ প্রধান বিচারপতি এবং বিচারপতিদের অপসারণকে কেন্দ্র করে । কিন্তু রায়ের বিষয়ে প্রধান বিচারপতি অনেক পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন । পর্যবেক্ষণ সমূহ প্রমাণ করে এ রায় রাজনৈতিক ভাবধারায় লিখিত । রায়ের মাধ্যমে জাতিকে রাজনৈতিক ভাবে বিভক্ত করা হয়েছে । প্রধান বিচারপতি কর্তৃক রায়ের পর্যবেক্ষণ নিয়ে সরকার এবং সরকার সমর্থকসহ আইনজীবী এবং সাবেক বিচারপতিগণও সমালোচনায় মুখর । সমালোচনা এমন পর্যায়ে উঠেছে যে, প্রধান বিচারপতিকে পদত্যাগ সহ দেশ ছাড়তে বলা হচ্ছে । সমালোচনায় বলা হয়েছে এ রায় বিচারপতির নিজের লিখা রায় নয় । এ রায় লিখেছেন একজন ইংরেজি দৈনিকের সম্পাদক । আরো বলা হচ্ছে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার নিয়ন্ত্রণে এ রায় লেখা হয়েছে । প্রধান বিচারপতি এস.কে সিনহা এর পূর্বে যত রায় দিয়েছেন সেসব রায়ের শব্দ/বাক্য চয়নের সাথে ষোড়শ সংশোধনী রায়ের শব্দ/বাক্য চয়নের মিল নেই । সমালোচনায় আরো বলা হয়েছে ৭৯৯ পৃষ্ঠার ষোড়শ সংশোধনী রায় মাত্র ২৪ দিনে লিখা হয়েছে । যা কোনভাবেই একজন বিচারপতির পক্ষে লিখা সম্ভব নয় এবং এরূপ ইতিহাস নেই । রায়ের পর্যবেক্ষণ নিয়ে এত ব্যাপক সমালোচনার ইতিহাসও নেই । সমালোচনায় আরো বলা হয়েছে । রায়ের পর্যবেক্ষণ রাজনৈতিক ভাবধারায় পক্ষপাতিত্ব করে লেখা । এসব কারণে প্রধান বিচারপতি বিচারকের নিরপেক্ষতা হারিয়েছেন । তার এ রায় বাতিল করা দরকার । আবার কেউ কেউ বলেছেন অনেক শব্দ/বাক্য এক্সপাঞ্জ করতে হবে । কারণ রায়ের পর্যালোচনা সমূহ অপ্রাসঙ্গিক অযৌক্তিক । এছাড়া প্রধান বিচারপতি তার রায় এবং পর্যবেক্ষণ দ্বারা রাজনৈতিক একপক্ষকে খুশি করেছেন এবং অপর পক্ষকে ক্ষুব্ধ করেছেন । সুতরাং এমন সব অপ্রাসঙ্গিক পর্যবেক্ষণ সম্বলিত রায় প্রকৃত অর্থে কারো কাম্য হতে পারে না । রায় পাঠে মনে হয়েছে কোন রাজনৈতিক প্রতিহিংসা পরায়ণ ব্যক্তি কর্তৃক লিখিত । পর্যবেক্ষণে মহান মুক্তিযুদ্ধে শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকাকে এমনভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে বিক্ষুব্ধ করেছে । একসাথে রায়ের নিরপেক্ষতা নিয়ে অভিযোগ করা হয়েছে । নিরপেক্ষতা না থাকলে কোন রায়কে ন্যায়ের মাপকাঠিতে বিচার করা যায় না । রায়ের এক পর্যবেক্ষণে প্রধান বিচারপতি এস.কে সিনহা বলেছেন সংবিধানের প্রারম্ভে “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম এবং রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আকাঙ্ক্ষা বিরোধী” কিন্তু কথা হল প্রধান বিচারপতি একথা কোথা থেকে এবং কেন আবিষ্কার করেছেন ? তা বোধগম্য নয় । তাছাড়া প্রধান বিচারপতির বক্তব্য এদেশের ইসলামীগণ মানুষের চেতনা, আকাঙ্ক্ষা এবং ইতিহাস বিরোধী । সুতরাং প্রধান বিচারপতির এ মন্তব্য অপ্রাসঙ্গিক এবং ঐতিহাসিক তথ্য বিকৃতি । কারণ স্বাধীনতা পূর্বকালেও কোন রাজনৈতিক দল ধর্ম নিরোপেক্ষতার কথা বলেনি । ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালে ঐতিহাসিক যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ১১ দফা, ৬ দফা, ৫৯-এর গণ অভ্যুত্থান এবং ১৯৭০-এ নির্বাচন কালেও ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা হয়নি । ১৯৭১ সালে ১০ এপ্রিল মুজিব নগরের স্বাধীনতা ঘোষণা পত্রেও ধর্মনিরপেক্ষতার কথা উল্লেখ নেই । অথচ এখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধর্মনিরপেক্ষতার সাথে একত্র করে ফেলা হচ্ছে । অথচ বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম এবং রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম এদেশের ৯৫ ভাগ মুসলিম জনগোষ্ঠীর ঈমান আক্বিকা ও ইসলামী মূল্যবোধের সাথে সংশ্লিষ্ট । বরং মুক্তি যুদ্ধের চেতনার সাথে ধর্মনিরপেক্ষতা, মূর্তি স্থাপন এবং হিন্দুত্ব ও নাস্তিক্যবাদী পাঠ্যসূচীর কোন সংশ্লিষ্টতা নেই । ১৯৫২ সালে কথিত বুদ্ধিবৃত্তির সিন্ডিকেট প্রভুশক্তির ইশারায় সুদূরপ্রসারী নীল নকশা অনুযায়ী বাংলাদেশের ইসলামিক আদর্শের প্রধান শিকড় কেটে ফেলে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ধর্শন সম্পূর্ণ নিয়ম বহির্ভূতভাবে বলপ্রয়োগ করে সংবিধানে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয় । সুতরাং এদেশের সিংহভাগ জনগোষ্ঠী কর্তৃক প্রখ্যাত সমাজতন্ত্র বহুবছর পূর্বেই নির্বাসিত হয়েছে । এখন ধর্মনিরপেক্ষতাকে নির্বাসনে পাঠাতে হবে । সংবিধানে বিসমিল্লাহির রাহমাননির রাহিম এবং রাষ্ট্রধর্ম ইসলামই থাকবে । এটা পরিবর্তের ক্ষমতা কারও নেই । এখানে বলা প্রয়োজন প্রধান বিচারপতি বলেছেন বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম এবং রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আকাঙ্ক্ষা বিরোধী । অথচ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা বিরোধী । কারণ মুক্তিযুদ্ধের সনদে উল্লেখ আছে শেখ মুজিবুর রহমান জাতিকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন “সর্বশক্তিমান আল্লাহর নামে আপনাদের প্রতি আমার আবেদন ও আদেশ, দেশকে স্বাধীন করার জন্য শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যান” (পৃষ্ঠা- ৩৯৯, শেখ মুজিবের লিখা অসমাপ্ত আত্নজীবনী, পৃষ্ঠা- ৪৬৪ আবুল মাল আব্দুল মুহিত সম্পাদিত এইদেশ এই মাটি) । এছাড়া মুজিবনগর সরকার কর্তৃক মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণায় বলা আছে “বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করতে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী রূপে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করলাম” । একথাগুল ইসলামেরই দাবী । এছাড়া শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন “যেদেশের মানুষ হালের গরু ও জমী বিক্রি করে হজ্জ্বে যায় সেদেশে ইসলাম ছাড়া কোন রাজনীতি করা যায় না” । এর পরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে ধর্মনিরপেক্ষতার সম্পর্ক থাকতে পারেনা । ধর্মনিরপেক্ষতা মানলে শেখ মুজিবুর রহমান ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা, রাষ্ট্রীয়ভাবে মদ নিষিদ্ধ, রমনার ঘোড়া দৌড়, জুয়া নিষিদ্ধ, মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড গঠন এবং তাবলীগ জামাতের জন্য টঙ্গী ইজতেমা ময়দান বরাদ্দ করতেন না । সুতরাং সংবিধানের প্রারম্ভে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম এবং সংবিধানে রাষ্ট্র ধর্ম ইসলামই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ।