নির্মাণ শ্রমিক থেকে বক্তাবলীর আল-আমিন ইকবাল রাতারাতি যেভাবে হল কোটিপতি:

1137

বক্তাবলী এলাকার রামনগর নিবাসী জনৈক গোলাম হোসেনের ছেলে আল-আমিন ইকবাল সিঙ্গাপুর প্রবাসী শ্রমিকদের টাকা কিভাবে প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়ে রাতারাতি একজন নির্মাণ শ্রমিক থেকে কোটিপতি বনে গেল তার বিস্তারিত ওঠে এসেছে সিঙ্গাপুর থেকে প্রকাশিত ‘বাংলার কণ্ঠ’ নামক পত্রিকার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে। উক্ত পত্রিকার ২০১৮ সালের জানুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত প্রতিবেদনটির প্রথম পর্ব পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হল:

“বাংলাদেশি কমিউনিটিতে এ যাবতকালের সর্ববৃহৎ আর্থিক কেলেংকারী

সিঙ্গাপুরে বহুমুখী কোম্পানির মোহময় জালে শত শত শ্রমজীবী প্রবাসী

বাংলার কণ্ঠ প্রতিবেদক: “রাষ্ট্রায়াত্ব ও স্বায়ত্বশাসিত ব্যাংকগুলো যেখানে ছয় বছরে টাকা দ্বিগুণ করে সেখানে সিঙ্গাপুরে অননুমোদিত আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে কোম্পানিটি স্বল্প সময়েই টাকা দ্বিগুণ করে দেয়ার লোভ দেখিয়ে হাতিয়ে নিলো কোটি কোটি টাকা। হাড়ভাঙা পরিশ্রমের অর্থ দিয়ে তথাকথিত সমবায় সমিতির শেয়ার সার্টিফিকেটের আড়ালে শ্রমজীবী প্রবাসীরা কিনলেন কাগজ। বছরের পর বছর বিনিয়োগের বিনিময়ে পেলেন স্বপ্নের বাড়ি, অ্যাপার্টমেন্টের রকমারি প্রিন্টিং ম্যাটেরিয়ালস, ভিডিওতে বিভিন্ন সুদৃশ্য প্রজেক্টের ছবি, মিটিংয়ে গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ, কোম্পানির খরচে বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপভোগের সুবিধা। কয়েক বছর যেতে না যেতেই শুনলেন কোম্পানি লস এ আছে। চেয়ারম্যান ঋণ দিয়ে দিয়ে কোনরকমে কোম্পানির কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। তারও দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে। আর আর্থিক সাহায্য দিয়ে কোম্পানি চালানো সম্ভব নয়। চাই আরও বিনিয়োগ। টাকা ফেরত চাইলে বলা হলো- জমি আছে নিয়ে নিন। কিন্তু সে জমি নিয়েও একটুখানি ঝামেলা আছে (চেয়ারম্যানের ভাষায়)। চাইলে দলিল নিতে পারেন। যদিও বাস্তবে কাগজে কলমে কোম্পানির ৩৭ পরিচালক, শত শত সদস্য সবাই লোকসানের ভাগীদার হলেও চেয়ারম্যানের সেসব নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই। তিনি বিভিন্ন নামে কোম্পানি খুলে শত শত প্রবাসীকে স্বপ্ন দেখিয়ে তাদের কষ্টার্জিত টাকার সফল বিনিয়োগের মাধ্যমে সাধারণ নির্মাণ শ্রমিক থেকে কোটিপতির খাতায় নাম লিখিয়ে ঢাকায় বিলাসবহুল হোটেল, রেস্টুরেন্টসহ সিঙ্গাপুরে একাধিক ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের লাভ-লোকসানের হিসেব নিয়ে ব্যস্ত।” এমনিভাবেই বাংলার কণ্ঠ’র অফিসে বসে নিজেদের স্বপ্নের প্রজেক্টের ইতিহাস শোনালেন উক্ত সমিতির কয়েকজন সাবেক পরিচালক ও ভুক্তভোগী শ্রমজীবী প্রবাসীরা।

 

কোনো প্রকার রেজিস্ট্রেশন বা লাইসেন্স পারমিট ছাড়া সিঙ্গাপুরের আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করেই বাংলাদেশি কমিউনিটির নাকের ডগায় বছরের পর বছর ধরে চলেছে সমবায় সমিতি নামক প্রতারণার সুকৌশলী ফাঁদ। অতি মুনাফার লোভ দেখিয়ে কয়েক শত সহজ-সরল গ্রাহকের কাছ থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এভারশাইন সমবায় সমিতি কোম্পানির মালিক ও তার আত্মীয় পরিজনেরা (যারা একই কোম্পানিতে বিভিন্ন পদে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিল)। সমিতির বিনিয়োগকারীরা এখন আসল টাকা ফিরে পেতে চাইলেও নানান তালবাহানায় সেটাও হচ্ছে না। যদিও এভারশাইন (ইশা) বহুমুখী সমবায় সমিতি’র কাগজে কলমে সদস্যদের মূলধন বিভিন্ন প্রজেক্ট যেমন- এভারশাইন ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, হাউজিং ডেভেলপমেন্ট, ইলেকট্রনিক্স মার্কেটিং, ট্রান্সপোর্টেশন, ট্যুরিজম, এডুকেশন, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, গার্মেন্টস, ডেইরি, ফিস এন্ড পোল্ট্রি, শপিং মল, এক্সপোর্ট ইম্পোার্ট(ট্রেডিং), স্বাস্থ্যসেবা(হাসপাতাল), পার্ক ডেভেলপমেন্ট, ড্রাই ফুড, ট্রি প্লান্টেশন, ভেজিটেবল ফার্ম, মানি এক্সচেঞ্জ, নিউজপেপার, মিনারেল ওয়াটার, ইশা ল্যান্ড জোন, সফটওয়্যার, স্কিল ডেভেলপমেন্ট প্রভৃতি বিনিয়োগ করার কথা জানিয়েছিল। তবে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন, সমিতির সদস্য ও পরিচালকদের বিনিয়োগকৃত অর্থের বৃহদাংশ সমিতির চেয়ারম্যান আল-আমিন ইকবালের ব্যক্তি মালিকানাধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করা হয়েছে।

 

সমিতির ভুক্তভোগী কয়েকজন সদস্য বলেন, লোভনীয় যতসব অফার আর স্বপ্ন দেখিয়ে সাধারণ শ্রমিক থেকে শুরু করে সিঙ্গাপুর ও বাংলাদেশে সব শ্রেণী-পেশার মানুষকে তারা সদস্য করতে সক্ষম হয়। সদস্যদের সঞ্চিত টাকা দিয়ে গড়ে তোলে বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান এবং ক্রয় করে সম্পত্তি (জমি)। এক পর্যায়ে আমরা জানতে পারি, কর্মকর্তাদের শালা-দুলাভাই, ভায়রা ভাই, মামা-খালু, মামাতো, ফুফাতো, জেঠাতো ভাই মোটকথা সব আত্মীয়-স্বজনেরা মিলে একটি প্যানেল (সিন্ডিকেট) হয়ে গেছে। তারা নাকি সমিতির তথা সব সম্পত্তির মালিক। আর আমরা অধিকাংশ সদস্য হয়ে যাই সাধারণ সদস্য অর্থাৎ গ্রাহক মাত্র। যখন মালিক-গ্রাহক ভাগাভাগি হতে লাগল তখনই মনে সন্দেহ জাগে আমাদের। তখন কর্মকর্তাদের জিজ্ঞেস করি, তাহলে আমাদের সঞ্চয় ও মুনাফার কী হবে? তারা উত্তর দেয়, মাসে ১০০ ডলার করে আপনাদের দু’বছরে জমা হয়েছে ২৪০০ ডলার এবং মুনাফা হয়েছে ১৮০ ডলার। দোকান ও জমিজমার কথা জিজ্ঞেস করলে বলেন, ওগুলো তো আমাদের ব্যক্তিগত। আপনারা গ্রাহক হিসেবে লাভ পাবেন। তাদের ব্যক্তিগত সংগঠনে কোম্পানির শেয়ার হোল্ডার থেকে আমরা এক লাফে হয়ে যাই ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চা। যাই হোক, তাদের হিসাব মোতাবেকই সঞ্চিত টাকা ফেরত চাইলে বলে, জমা দিয়েছেন মাসে মাসে আবার ফেরতও নিতে হবে মাসে মাসে কিস্তিতে, জমাকালীন সময়ের ডলারের বিনিময় রেট অনুযায়ী। কি চমৎকার! এ যেন আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপের চেয়েও আশ্চর্য পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন তারা। আমাদের রক্ত পানি করা টাকায় ব্যবসা করে মালিক হবেন তারা আর আমরা উচ্ছিষ্টরা ভাগাড়েই পড়ে রই!

 

বিনিয়োগকারীদের আরেকজন বলেন, ইকবাল ভাই আমাদের মতোই একজন সাধারণ শ্রমিক হিসেবে সিঙ্গাপুরের নির্মাণ শিল্পে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন গ্যামমন প্রাইভেট লিমিটেড নামক একটি কোম্পানিতে। কয়েক বছর চাকরি করার পর পরিচিত কয়েকজন সহকর্মী নিয়ে চাকরির পাশাপাশি প্রথমে লাইসেন্স পারমিট ছাড়া একটি ক্যাটারিং চালু করেছিলেন যা কয়েক বছর পরে তাহেরা ক্যাটারিং নামে নিবন্ধন করা হয়। প্রথম দিকে নিজেই সাইকেল চালিয়ে কাছাকাছি এলাকায় ক্যাটারিং এর খাবার শ্রমিকদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতেন। ২০০৮ সালের দিকে যখন তিনিসহ উক্ত সমিতির আরো কয়েকজন নিকট আত্মীয় কর্মকতা বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি প্রবাসী শ্রমিকদের চিন্তা মাথায় রেখে সমিতি করার কথা বলেন, তখন তিনি আমাদেরই একজন ভেবে আমরা রাজি হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম কষ্ট করে হলেও একটা স্বপ্নের ব্যবসায় বিনিয়োগ করছি। সাধারণ সদস্য হিসেবে প্রতি মাসে অনেকেই এক নামে ১০০ আবার অনেকে দুই নামে ২০০ ডলার জমা দিয়ে বৃহৎ প্রকল্পের (বিভিন্ন প্রকল্পের ভিডিও দেখে) অংশীদার হওয়ার স্বপ্ন লুফে নিয়েছিল। পরবর্তীতে কোম্পানির লভ্যাংশ বণ্টনের কথা বলে ৩ ধাপে পরিচালক বানিয়ে দেয়ার লোভ দেখিয়ে কারও কাছ থেকে ৫ লাখ ও কারও কাছ থেকে ১০ লাখ করে টাকা নিয়েছে। এদিকে, দিনে দিনে আমাদের সমিতির সদস্য সংখ্যাও দ্রুত বৃদ্ধি পেলে আমাদের ৫/৬ ‘শ সদস্যদের দিয়েই তার ক্যাটারিং ব্যবসা ফুলে ফেঁপে উঠতে লাগলো। আমরা সিঙ্গাপুরে বসে শুনছিলাম আমাদের বিনিয়োগকৃত অর্থ দিয়ে দেশে জমি কেনা হচ্ছে, প্রতিশ্রুত বিভিন্ন প্রজেক্টও চালু করা হচ্ছে। একবার ঢাকায় যেয়ে দেখি ইত্তেফাক ভবনে বিশাল ব্যয়বহুল অফিস(অফিসের ভাড়া ১ লক্ষ ৬৫ হাজার টাকা)। সেখানে পুরো গ্লাসের কয়েকধাপ পেরিয়ে, দারোয়ান, পিয়ন, আর্দালি বেষ্টিত দামী চেয়ার অলংকৃত করে রেখেছেন আমাদেরই আরেকজন প্রবাসী শ্রমিক ভাই যিনি সিঙ্গাপুরে আমাদের সাথেই কাজ করতেন। তিনি এভারশাইন সমিতির অন্যতম উদ্যোক্তা জাকির হোসেন খোকন। একসময় সে চেয়ারম্যানের আস্থাভাজন হয়ে সিঙ্গাপুরের ওয়ার্ক পারমিটের অধীনে সাধারণ শ্রমিকের কাজ ছেড়ে এভারশাইন সমিতির মোটা অংকের বেতনে বাংলাদেশে এভারশাইন প্রপার্টিজ এন্ড ডেভেলপমেন্ট লি.(ইপিডিএল) এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। কোম্পানির বাহ্যিক চাকচিক্য, কম্পিউটারের মনোরম প্ল্যানিং প্রজেক্ট দেখে, চেয়ারম্যান, ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও তাদের আত্মীয়-স্বজনের অলংকৃত পদাধিকারধারীদের মিষ্টি মিষ্টি কথা শুনে কখনও মনে হয়নি এখানেও আমরা প্রতারণার শিকার হতে যাচ্ছি। ২০১৬ সালে জানানো হলো- শ্যামলীতে ৭ কাঠার প্লট কেনা হয়েছে; ৮ তলা বিল্ডিং বানানো হবে। প্রজেক্ট ব্যয় ধরা হলো ১ কোটি ৯২ লক্ষ টাকা। কিছুদিন পরে শুনি প্রজেক্টের কাজ টাকার অভাবে আটকে আছে। কোম্পানি লোকসানের মুখ দেখছে। ঐ বছরই ১০ অক্টোবর এক মিটিং এ জানানো হয়- সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর পর্যন্ত কোম্পানির চেয়ারম্যান প্রজেক্ট এইচএল-০১, ০২ এর কার্যক্রম পরিচালনার জন্য মাসিক ৩% হারে ১০ লক্ষ টাকা ও চেয়ারম্যান এর অন্য আরেকটি প্রতিষ্ঠান তাজরিয়ান ফুড এন্ড বেভারেজ থেকে ৫ লক্ষ টাকা কোম্পানিকে ঋণ প্রদান করেছেন। ২০১৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পুনরায় এক চিঠিতে জানানো হয়, কোম্পানির অবস্থা ভালো নয়। প্লট গ্রাহক, সমিতির সদস্য এবং বিনিয়োগকারীদের টাকা ফেরত দেয়ার চাপ থাকায় বেশ কিছু জমি বিক্রি করে তাদের টাকা রিফান্ড দেয়া হয়েছে। ফলে প্রজেক্টের কাজ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। কোম্পানির চেয়ারম্যান আল-আমিন ইকবাল এর নিকট থেকে আর্থিক সহযোগিতা নিয়ে কিছু কিছু কাজ করা হয়েছে। অফিসের কর্মকর্তা, কর্মচারীদের বেতন বাকি আছে। অথচ আমার জানা মতে, পরিচতি সবাই তার কাছে ঘুরছে বিনিয়োগের টাকা ফেরত পেতে। তিনি শুধু জমি দেখিয়ে, আশ্বাস দিয়েই সবাইকে শান্তনা দিয়ে যাচ্ছেন। এর ২ মাস পরে কোম্পানির ৫১ শতাংশের শেয়ার দাবীদার চেয়ারম্যান আল-আমিন ইকবালকে কোম্পানির পুরো দায়িত্বভার বুঝিয়ে দেয়ার জন্য জরুরি মিটিং আহবান করা হয়।

 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সমিতির আরেকজন সাবেক পরিচালক বলেন, এভারশাইন সমিতি সদস্যদের নিকট থেকে মাসে ১০০ ও কারও কাছ থেকে ২০০ ডলার হারে কিস্তি নিত। এছাড়া প্রাথমিক পর্যায়ে যারা পরিচালক পদ কিনেছেন তারা ৫ লক্ষ এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপে যারা পরিচালকের পদ কিনেছেন তারা দিয়েছেন ১০ লাখ টাকা করে। সর্বমোট ৩৭ জন পরিচালক। আমি সমিতির শুরু থেকেই ছিলাম। গত বছর আমাদের বলা হয়েছে- কোম্পানি লোকসানে আছে, আরও বিনিয়োগ করতে হবে। আমাদের নিকট থেকে নেয়া অর্থ সমিতি কোথায় বিনিয়োগ করেছে তার কোন সুষ্পষ্ট জবাব পাইনি। উক্ত পরিচালক আরও বলেন, আমার টাকা ফেরত দেওয়ার আশ্বাস বহুবার দিয়েছে। সুপরিকল্পিত পুরো প্রতারণার জাল বিস্তারের অন্যতম হোতা সিঙ্গাপুরে মাইগ্র্যান্ট কবি হিসেবে পরিচিত জাকির হোসেন খোকন চেয়ারম্যানের ডান হাত হিসেবে কোম্পানি শুরুর দিকের কয়েকজন পরিচালকের সাথে এই মাস্টারমাইন্ড প্রতারণার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন।

 

আরেক বিনিয়োগকারী বলেন, বিশাল সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখিয়ে আমাদের নিকট থেকে এসকল অর্থ হাতিয়ে নেয়া হয়েছিল। কেরানীগঞ্জ, মোহাম্মদপুর, গেন্ডারিয়া, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, মুগদা, বাসাবো, ধানমন্ডি, বনানী, মিরপুর-১ ও ১০, খিলক্ষেত, উত্তরা এলাকায় বিশাল বিশাল প্রজেক্টের ছবি দেখেছি। কিন্তু কাজির গরু কেতাবের মতোই বাস্তবে এর কিছুই চোখে পড়েনি। কোম্পানির পরিচালক ও সদস্যদের আইওয়াশ করার জন্য পানির মধ্যে অল্প কিছুজমি কিনেছে। শুনেছি কোথাও কোথাও স্থানীয় ভূমি দালালদের কিছু টাকা দিয়ে অন্যের জমিকে কোম্পানির জমি দেখিয়ে সাইনবোর্ড লাগিয়ে দিয়েছে। যদিও পরে যাদের জমি তারা নাকি সাইনবোর্ড তুলে ফেলে দিয়েছে। সেসময় রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের দোহাই দিয়ে বলা হয়- ক্রয়কৃত জমি নিয়ে কোম্পানি ঝামেলায় জড়িয়েছে। এখন জমি, প্রজেক্ট, আমাদের বিনিয়োগ কোনকিছুই পাচ্ছি না। উল্টো বলা হচ্ছে, কোম্পানির লাভ-লস থাকবেই। আগের টাকার নয়ছয় খরচের খাত দেখিয়ে বলছে আরও টাকা বিনিয়োগ করতে হবে।

 

আরেক বিনিয়োগকারী সদস্য বলেন, মাসিক লভ্যাংশ পাওয়ার শর্তে এভারশাইন সমবায় সমিতিতে ৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করি। নানান সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার কথা বললেও পরবর্তীতে দেখি কোম্পানির মালিক ও তার আত্মীয়-স্বজনরাই সর্বেসর্বা। প্রায় আট বছর অতিবাহিত হয়ে গেলেও মাসিক লভ্যাংশ তো দূরে থাক আমরা আমাদের মূলধনেরই টাকা পাচ্ছি না। আর ভবিষ্যতে পাওয়ারও কোনো সম্ভাবনা দেখছি না। শুনেছি প্রভাবশালী কিছু সদস্যকে এভারশাইন কিছু জমির দলিল বুঝিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আমাদের টাকা কবে ফেরত পাব সে ব্যাপারে কোন সদুত্তর পাচ্ছি না, কিছু বুঝে উঠতেও পারছি না।

 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এমন আরো অনেক ভুক্তভোগীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এভারশাইন সমবায় সমিতির পরিচালনা পর্ষদ গ্রাহকদের অর্থ আবাসন প্রকল্প, ইলেকট্রনিক্স প্রকল্প, জমি ক্রয়, সুপারশপ প্রকল্পে বিনিয়োগ দেখালেও মূলত এসব ছিল কাগজেপত্রে। গ্রাহকদের টাকা সম্পূর্ণ আইনবহির্ভূতভাবে এভারশাইন গ্রুপে বিনিয়োগ করা হয়। তারা ইতোমধ্যে শুধুমাত্র কাগজেপত্রে শতশত বিঘার প্লট বিক্রি করে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। তারা ঢাকার কোন একটি এলাকায় মাত্র কয়েক কাঠার একটি জলাভূমি কিনে দাবি করছে পুরো এলাকাটি কিনে নিয়েছে। টানিয়ে দিয়েছে বিশালাকার সাইনবোর্ড। ওই এলাকার একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিকে (তার রয়েছে শতশত বিঘা জমি) তাদের সুবিধাভোগীর দলে ঠাঁই করে দিয়েছে। এখন কেউ খোঁজ নিতে গেলে তাদের নিযুক্ত দালালেরা চোখ বুজে বলে দেয় সব জায়গা ইতোমধ্যেই উক্ত কোম্পানি কিনে নিয়েছে। এছাড়াও সমিতির পর্ষদবর্গের বিলাসী জীবন যাপনেও বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হয়েছে।

 

জানা যায়, ২০০৯ সালে প্রথমে ‘এভারশাইন অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ’ নামে, পরবর্তিতে একই সালে ‘এভারশাইন (ইশা) বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেড’ নামে বাংলাদেশে নিবন্ধনকৃত সমিতিটি একটি লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে সিঙ্গাপুরে যাত্রা শুরু করে। ২০১০-১২ সালের মধ্যে ঢাকার মাওয়া রোডের ভাউরভিটি আবদুল্লাহপুর, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জকে কেন্দ্র করে চালু করা হয় ‘এভারশাইন সিঙ্গাপুর সিটি’। মূলত ‘এভারশাইন সিঙ্গাপুর সিটি’ নামে আকৃষ্ট হয়েই সিঙ্গাপুরে কর্মরত প্রবাসীরা সমিতির সদস্য হতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। ২০১৩ সালে শ্যামলী হাউজিং লিমিটেড, মোহাম্মদপুরে দ্য পাইওনিয়ার প্রজেক্ট এভারশাইন মেহেদি হোমস (ইএইচএল-১) চালু করা হয়।

 

অভিযোগ রয়েছে, কোম্পানির চেয়ারম্যান আল-আমিন ইকবাল সিঙ্গাপুরে সামান্য শ্রমিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করে শুধুমাত্র বুদ্ধি ও মেধা খাটিয়ে কইয়ের তেলে কই ভাজার মতো শত শত শ্রমজীবী সতীর্থদের কষ্টোপার্জিত টাকার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করছেন নিজেকে, নাম লিখিয়েছেন সমাজের প্রভাবশালীদের স্তরে। অপরের বিনিয়োগ দিয়েই ঢাকায় গড়ে তুলেছেন উন্নতমানের হোটেল-রেস্টুরেন্ট, ফুড প্রসেসিং এবং সিঙ্গাপুরে একাধিক রেস্টুরেন্টসহ বিভিন্ন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান। পায়ের তলায় মাটি শক্ত করতে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করেছেন নিজেকে। ভাষা দিবস ও স্বাধীনতা দিবস উদযাপন, বৈশাখী মেলা, বই মেলা ও সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা, নজরুল জন্ম-জয়ন্তী ও রবীন্দ্র জয়ন্তী উদযাপন, বাৎসরিক বনভোজন, খেলাধূলা, ইফতার পার্টিও দোয়া মাহফিল, ঈদ আনন্দ মেলা, বিজয় দিবস উদযাপনের মধ্য দিয়ে সমাজের বিশিষ্ট স্তরের মধ্যে নিজের আসনটি পাকাপোক্ত করার পাশাপাশি এইসব অনুষ্ঠানে সিঙ্গাপুরস্থ বাংলাদেশ হাই কমিশনের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, আমন্ত্রণ জানিয়েছেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট সুধীজনসহ সিঙ্গাপুরের বাংলাদেশি কমিউনিটি এবং ব্যবসায়িক সংগঠনের নেতৃবৃন্দদেরকেও। আমন্ত্রিত কর্মকর্তা ও অতিথিদের উদ্দীপনাযুক্ত উৎসাহব্যঞ্জক বক্তব্য শুনে সহজ-সরল শ্রমজীবী প্রবাসীরা পঙ্গপালের মতো আকৃষ্ট হয়েছেন তথাকথিত সমবায় সমিতিতে। বাংলাদেশ হাই কমিশনের সাবেক শ্রম কাউন্সিলর ইয়াসমিন সুলতানাকে তো তাদের প্রায় প্রতিটি অনুষ্ঠানেই অংশগ্রহণ করতে দেখা যেতো। বাদ যাননি সাবেক হাই কমিশনার এইচএম কামরুল আহসানও।

 

 

কোম্পানির চেয়ারম্যান আল-আমিন ইকবালের উদ্ধৃতিতে হাই কমিশনের কাছে পাঠানো একটি চিঠির অংশবিশেষ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো: “১লা জানুয়ারী ২০০৯ ইং সিঙ্গাপুরস্থ প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকদের নিয়ে গড়ে উঠে এভারশাইন (ইশা) বহুমুখী সমবায় সমিতি নামে একটি সংগঠন। কিছু মহৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করাই এই সমিতির মূল লক্ষ্য। যেমন, এভারশাইনের সকল সদস্যদের জন্য বাংলাদেশে স্থায়ী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা, প্রবাসে বাংলাদেশি সংস্কৃতিকে তুলে ধরা, সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশি শ্রমিকদের এদেশের নিয়ম-শৃঙ্খলা সম্পর্কে সচেতন করা। স্যার, আপনি জেনে আনন্দিত হবেন যে ইতিপূর্বে এভারশাইন প্রবাসীদের নিয়ে উদযাপন করেছে ভাষা দিবস, স্বাধীনতা দিবস এবং বইমেলা। আয়োজন করে পিলখানার বর্বরোচিত ঘটনায় নিহত সেনাদের শোকসভা ও দোয়া মোনাজাতের, যেগুলো সিঙ্গাপুর ও বাংলাদেশের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়।” তাদের নিউজ কভারেজ করার জন্য বাংলার কণ্ঠকেও মিডিয়া পার্টনার হিসেবে বেশ কয়েকবার আমন্ত্রন জানানো হয়েছিল। সেসময়ে এভারশাইনের ঘোষিত মহৎ উদ্দেশ্যে সাড়া দিয়ে হাইকমিশনার কর্মকর্তাবৃন্দসহ ইশা’র বইমেলায় অংশগ্রহণ করেছেন। আল-আমিন ইকবালের আয়োজনকৃত ইফতার পার্টি ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের শোভাবর্ধন করেছেন সিঙ্গাপুরস্থপ্রবাসী ব্যবসায়ী ও কমিউনিটির বিশিষ্ট জনেরাও। বাদ যাননি দেশের রাঘব বোয়ালরাও। তাদেরকে দেশে স্পেশাল ট্রিটমেন্ট দেওয়া হয়েছে বলেও শোনা যায়।

 

 

শুধু সিঙ্গাপুরে প্রবাসী শ্রমজীবী ভুক্তভোগীরাই আল-আমিন ইকবালের প্রতারণার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে তা কিন্তু নয়, দেশের অভ্যন্তরে তার নিজ জেলা নারায়ণগঞ্জেও আওয়ামী ও বিএনপি পন্থীরা জামায়াত শিবিরের পৃষ্ঠপোষাক হওয়ার অভিযোগে তার সাথে এক সামিয়ানার নিচে অনুষ্ঠানে অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। নিচে স্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশিত কয়েকটি রিপোর্টের কিছু চুম্বক অংশ হুবহু তুলে ধরা হলো-

জামায়াতের পৃষ্ঠপোষক আলআমিন ইকবালের নাম থাকায় লীগবিএনপির দুই নেতার অনুষ্ঠান বর্জনের ঘোষণা

নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার বক্তাবলীতে শহীদ গণহত্যা দিবসের অনুষ্ঠান বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন ফতুল্লা থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বক্তাবলী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান এম. শওকত আলী ও ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এড. আল আমীন সিদ্দিকী। অভিন্ন কারণে বিপরীতমুখী রাজনৈতিক অবস্থানের এই দুই নেতা ‘শহীদ পরিবারের সন্তান’ নামের একটি সংগঠনের ওই অনুষ্ঠান বর্জন করবেন বলে জানিয়েছেন। উভয়ের অভিযোগ, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন না আল-আমিন ইকবাল নামের এমন একজনকে অনুষ্ঠানে অতিথি করা হয়েছে। আল-আমিন ইকবাল শুধু স্বাধীনতা বিরোধীদের সমর্থকই নন, তিনি জামায়াতের পৃষ্ঠপোষকও। বুধবার (২৯ নভেম্বর) বিকাল ৩টায় বক্তাবলীর লক্ষীনগর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে অনুষ্ঠানটি হবার কথা রয়েছে। এ প্রসঙ্গে থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বক্তাবলী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান এম. শওকত আলী জানান, ওই ব্যক্তিটি বিভিন্নভাবে তার স্বাধীনতাবিরোধী অবস্থানের বিষয়টি পরিষ্কার করেছেন। এমনকি তিনি যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তি দাবি করেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ সক্রিয়। এমন একজন ব্যক্তির সাথে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার প্রশ্নই উঠে না। তিনি বলেন, তাছাড়া আয়োজকরা আমাকে বিষয়টি আগে অবগত করে নাই। আমি বঙ্গবন্ধু আর্দশের সৈনিক, কোন স্বাধীনতাবিরোধীর সাথে আপোসের সুযোগ নেই। অন্যদিকে, একই অভিযোগ এনে অনুষ্ঠানের আয়োজকদের ছাপানো পোস্টার থেকে নিজের নাম মুছে ফেলার অনুরোধ করেন ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এড. আল আমীন সিদ্দিকী। এমনকি পোস্টারে যদি নাম মুছে ফেলা না হয় তবে তিনি মামলারও হুমকি দেন। নিউজ প্রতিদিন.নেট, নভেম্বর ২৮, ২০১৭

 

ইকবাল বিএনপি কেউ না!” 

ফতুল্লা থানাধীন বক্তাবলী ইউনিয়ন বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট আল আমীন সিদ্দিকী বিএনপি নামধারী আল-আমিন ইকবালের বিরুদ্ধে জামায়াত শিবিরের পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ তুললেও তার বেতনভুক্ত কর্মচারী ও অনুগামীরা তাকে বিএনপি’র কর্মী হিসেবে দাবি করছে। ইকবালকে বিএনপি’র কর্মী হিসেবে দাবি করলেও তার অনুগামীরা সঠিকভাবে প্রমান দিতে পারেনি। তবে ইকবালের অনুগামীরা ৫ টাকা মূল্যের সদস্য ফরম ক্রয়ের প্রমাণ দেখিয়ে বিএনপি’র কর্মী দাবি করলেও দলের শীর্ষ নেতারা বলছে বর্তমানে ৫ টাকা মূল্যের ফরম অবৈধ। এটার কোন বৈধতা নেই। …জানা যায়, বক্তাবলীতে ২৯ নভেম্বর গণহত্যা দিবসে একটি অনুষ্ঠানে অতিথির তালিকায় ইউনিয়ন বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক আল আমীন সিদ্দিকীর নামসহ এলাকার অনেক শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের নামের আগে আল আল-আমিন ইকবালের নাম থাকায় এলাকায় সমালোচনার সৃষ্টি হয়। এতে করে আল-আমিন ইকবালের বিরুদ্ধে জামায়াত শিবিরের পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ তোলেন এডভোকেট আল আমীন সিদ্দিকী। এতে করে এডভোকেট আল আমীন সিদ্দিকীসহ অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি বক্তাবলী ইউপি চেয়ারম্যান ও ফতুল্লা থানা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক আলহাজ মো. শওকত আলী অনুষ্ঠান বয়কট করেন। পরে আয়োজকরাও অনূষ্ঠান করা থেকে বিরত থাকেন। আল-আমিন ইকবাল জামায়াত শিবিরের পৃষ্ঠপোষক এমন অভিযোগ উঠায় অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি বয়কট করেছে বলে এলাকাবাসী এমনটাই জানিয়েছেন। এদিকে অভিযোগ উঠেছে আল-আমিন ইকবাল ধনী হওয়ায় তার পিছনে বিএনপি ও আওয়ামী নামধারী কিছু বেতনভুক্ত দালাল রয়েছে। যার কারণে আল-আমিন ইকবাল এলাকায় প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করে। তার বিরুদ্ধে জামায়াত শিবিরের পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ প্রকাশ্যে উঠে আসলে থলের বেড়াল বের হতে শুরু করে। আল-আমিন ইকবালের বিরুদ্ধে যেহেতু ইউনিয়ন বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট আল আমীন সিদ্দিকী জামায়াত শিবিরের পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ করেছে তাই এলাকাবাসী বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছে। ” নিউজ প্রতিদিন.নেট, ডিসেম্বর ১০, ২০১৭

 

প্রবাসী বাংলাদেশি কমিউনিটিতে জনশ্রুতি ও একই সাথে অভিযোগও রয়েছে, সিঙ্গাপুরে জামায়াতপন্থী হিসেবে আল-আমিন ইকবাল বেশ কিছু কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছেন। ১২ জুন, ২০১৩ সালে আল-আমিন ইকবালের সিঙ্গাপুর রোয়েল রোডস্থ খানা বাসমতি রেস্টুরেন্ট এর খোলা চত্বরে ‘৭১ এর গণহত্যাকারী, আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত কুখ্যাত রাজাকার মাওলানা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে সিঙ্গাপুর প্রবাসী বাংলাদেশি কমিউনিটি’র ব্যানারে প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করা হয়। কথিত আছে যে, আল-আমিন ইকবালের পৃষ্ঠপোষকতায় আয়োজিত উক্ত সমাবেশে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে জামায়াত শিবিরপন্থী প্রবাসী শ্রমিক ও এভারশাইন (ইশা) সমবায় সমিতির সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। পরে নাকি উক্ত সমাবেশে অংশগ্রহণকারী সকল প্রবাসী শ্রমিকদেকে তার রেস্টুরেন্টে আপ্যায়িত করা হয়।

 

বাংলার কণ্ঠ’র পক্ষ থেকে সমবায় সমিতির ভুক্তভোগীদের অভিযোগ ও জামায়াত শিবিরের সাথে তার সম্পৃক্ততার বিষয়ে আল-আমিন ইকবালের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “আমি অর্থ উপার্জন করি, কিছু ভালো কাজে টাকা ব্যয় করি। এলাকায় একটি স্কুল করে দিয়েছি। এজন্য অনেকেই আমাকে পছন্দ করেন। আবার অনেকেই করেন না। যারা আমার সাথে অনুষ্ঠান না করার কথা বলেছেন তারা একসময়ে আমার সাথে অনেক অনুষ্ঠানেই উপস্থিত ছিলেন। এখন থাকবেন না বলেছেন। এটা তাদের ব্যাপার। আর সমিতির সদস্যরা যে অভিযোগ করেছেন তা সত্য নয়। কোম্পানির অফিস চালু আছে। জমি দিয়ে সদস্যদের মূলধন সমন্বয়ের চেষ্টা করা হচ্ছে। কোম্পানির অফিস ভাড়া, কর্মচারীদের বেতন, ব্যানার, টিভি অ্যাড, মার্কেটিং, বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজনে অনেক টাকা ব্যয় হয়েছে। সিঙ্গাপুর থেকে টাকা হ্যান্ডেল করতো ইলিয়াস। বাংলাদেশে সেই টাকা গ্রহণ করতো কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর জাকির হোসেন খোকন। মূলত এভারশাইন কোম্পানিতে দুর্নীতির মূল হোতা ছিলো জাকির হোসেন খোকন। সে ২০১২ সালে খরচ বাবদ সদস্যদের বিনিয়োগের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ ব্যয়ের খাতে দেখায়। সে শুধুমাত্র প্রিন্টিং বাবদই ৯০ লক্ষ টাকা খরচ করেছে। তখন আমি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের অবস্থা বিবেচনা করে তাকে এই বিষয়ে সাবধান করলে সে তার চেয়ারের ক্ষমতাবলে কোম্পানিকে করায়ত্ত¡ ও আত্মসাৎ করার চেষ্টা করে। সেসময় আমরা তার হীন উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে অন্যান্য সকল পরিচালকদের সম্মতিতে তাকে এক পর্যায়ে বের করে দেই। এছাড়া বিলবোর্ড, টিভি অ্যাড, অফিস ভাড়া খরচ, স্টাফদের বেতন ও বিভিন্নরকম অনুষ্ঠানের আয়োজন বাবদ ১৩/১৪ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। কোম্পানির লেনদেন হয়েছে ২১ কোটি টাকা। কোম্পানির সদস্যদের টাকা দিয়ে জমিও কেনা হয়েছে, কিন্তু যে দামে কেনা হয়েছে তার পিছনে কয়েকগুণ বেশি ব্যয় হয়েছে। আবার রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে আমাদের কয়েকটি প্রজেক্টের কাজ বন্ধ রয়েছে। কোম্পানির সম্পদ বলতে কেবল জমি আছে। তবে তা আরেক পক্ষ দখল করে নিয়েছে। আমাদের কাছে জমির দলিল আছে। সিঙ্গাপুরের ২৫০ সদস্যদের মধ্যে অনেকেরই টাকা ফেরত দেওয়া হয়েছে। ৩০/৪০ জন বাকি আছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে সাড়ে ৫ কোটি টাকা পরিশোধ করেছি। বাংলাদেশে যারা জমি বুকিং দিয়েছিল তাদের টাকা ফেরত দেওয়া বাকি আছে। তাদেরকে জমির দলিল দিতে চেয়েছি। কোম্পানিতে আমি পেতাম ৭ কোটি টাকা। এর বিনিময়ে অন্যান্য পরিচালকরা মিলে আলোচনা করে কোম্পানির শেয়ার দিয়েছে। এখনও পাব আড়াই কোটি টাকা। ব্যবসায় লাভ-লোকসান থাকবে। আমি যদি টাকা বিনিয়োগ করি অন্যান্য পরিচালকদেরও তো বিনিয়োগ করতে হবে।”

 

 

সমবায় সমিতির নামে কৌশলী প্রতারণার ফাঁদ পেতে সাধারণ সদস্যদের আমানতের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার ঘটনা বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়। তবে সিঙ্গাপুরের মত একটি স্বচ্ছ আইন ও শতভাগ নিয়মানুবর্তী দেশে যেখানে কোন প্রকার লাইসেন্স পারমিট ছাড়া ফুটপাতের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ও করা যায় না, সেখানে এদেশের আইন ও বাংলাদেশি কমিউনিটির চোখে ধূলো দিয়ে বছরের পর বছর অনিবন্ধিত আর্থিক লেনদেনের প্রতিষ্ঠান খুলে জীবন-জীবিকার কঠিন সংগ্রামে নিয়োজিত নিম্ন আয়ের সাধারণ শ্রমিকদের মিথ্যে স্বপ্ন দেখিয়ে স্রেফ প্রতারণার মাধ্যমে তাদের কষ্টার্জিত কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার বিষয়টি খুবই উদ্বেগজনক। নিজেরা শ্রমিক হয়ে স্বদেশি অপর শ্রমিক ভাইদের রক্তচোষা অর্থ দিয়ে বিত্তের বৈভব গড়া এই প্রতারক সিন্ডিকেটের রাহুগ্রাস থেকে মুক্তি চায় ভুক্তিভোগী শ্রমজীবী প্রবাসীরা। বহুল আলোচিত ‘যুবক’ ও ‘ডেসটিনি’র প্রতারণা তো এখনও উদাহরণ হয়ে আছে। এভারশাইন সমবায় সমিতির অর্থ আত্মসাতের ঘটনা এরই ধারাবাহিকতা মাত্র। দেখা যাচ্ছে, আমানত সংগ্রহের আগে প্রতিষ্ঠানটি আর দশটি ‘হায়-হায় কোম্পানি’র মতোই একই পথ অনুসরণ করে অতি মুনাফায় প্রলুব্ধ করেছে এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সম্পৃক্ততার আড়ালে কৌশলে মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জনের কাজটি সহজ হয়েছে। ফলে গ্রাহকেরা সরল বিশ্বাসে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। এক পর্যায়ে কয়েকশত শ্রমজীবী প্রবাসী সদস্যদের কাছ থেকে বিপুল অংকের অর্থ সংগ্রহের পর উন্মোচিত হয়েছে তাদের আসল রূপ।

 

বি. দ্র. বাংলার কণ্ঠ’র কাছে এভারশাইন গ্রুপ ও সমবায় সমিতির ভুক্তভোগী আরো অনেক সদস্য অভিযোগ জানিয়েছেন। সময়ের স্বল্পতা ও স্থান সঙ্কুলানের অভাবে এ সকল অভিযোগের স্বল্পবিশেষ বক্ষ্যমান নিবন্ধে তুলে ধরা হলো মাত্র। পরবর্তীতে এ সম্পর্কিত আরো ফলোআপ পাঠকদের সামনে তুলে ধরা হবে।”