কাজী সিরাজ : সাম্প্রতিক সময়ে দেশে সংঘটিত গুপ্তহত্যার সঙ্গে বিএনপি-জামায়াত জড়িত বলে আবারও মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত ২৯ জুন বুধবার জাতীয় সংসদে ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরের বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে বেগম খালেদা জিয়ার জঙ্গি সম্পৃক্ততা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। মাদারীপুর নাজিমুদ্দিন কলেজের অধ্যাপক রিপন চক্রবর্তীকে হত্যার প্রয়াস চালিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় জনতার হাতে ধৃত ফাহিম ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়ার পর বেগম খালেদা জিয়া এর কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন তুলেছেন, ফাহিমের জন্য খালেদার মায়াকান্না কেন? দীর্ঘদিন ধরে সরকারপক্ষ বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে জঙ্গি তৎপরতায় সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ করে আসছে। সে হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর অভিযোগটি নতুন নয়। অতি সম্প্রতি বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াও জঙ্গি তৎপরতায় সরকারি দল জড়িত বলে অভিযোগ করে চলেছেন ধারাবাহিকভাবে। পারস্পরিক এই অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগকে আমাদের দেশের অসুস্থ রাজনীতির স্বাভাবিক প্রকাশ বলেই ধরে নেওয়া যায়। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, দুই নেত্রী এবং দুই দলের এই ব্লেম গেম প্রকৃত অপরাধী চিহ্নিতকরণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতিই সৃষ্টি করে। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, জঙ্গি তৎপরতা থামছে না জঙ্গি গ্রেফতারে ও জঙ্গি দমনে তেমন কোনো সাফল্যও দেখা যাচ্ছে না। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিভিন্ন মহল থেকে আওয়াজ উঠতে শুরু করেছে যে, জঙ্গি দমনে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়া জরুরি। দল, মত নির্বিশেষে সবার ঐক্যের ওপর জোর দিচ্ছেন সবাই। কিন্তু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং মাঠের প্রকৃত বিরোধী দল বিএনপি এ ব্যাপারে একমত না হলে কাক্সিক্ষত সার্বজনীন জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা যে সম্ভব নয়, তা অবশ্যই উপলব্ধি করতে হবে। তবে এ ব্যাপারে ক্ষমতাসীনদেরই উদ্যোগটা নিতে হবে। আশার কথা হচ্ছে, বেশ কিছু দিন ধরে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জঙ্গি সংকট মোকাবিলায় জাতীয় ঐক্য-উদ্যোগ গ্রহণের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছেন। পার্টি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াও জঙ্গি সংকট সমাধানে ঐক্যবদ্ধ যে উদ্যোগ গ্রহণের কথা বলছেন, তা দলের মহাসচিবের বক্তব্যকে আরও অর্থপূর্ণই করে তোলে। বলা যায়, জঙ্গি সমস্যা সমাধান করার ব্যাপারে সরকারের যে কোনো কার্যকর ও সৎ উদ্যোগের সঙ্গে বিএনপি যুক্ত হতে সম্মত আছে। জঙ্গি সমস্যাটি এককভাবে ক্ষমতাসীন সরকার বা কোনো দলবিশেষের সংকট নয়; এটি সব দলের সংকট, সমগ্র জনগণের সংকট— জাতীয় সংকট। সরকারের উচিত এ ব্যাপারে বিএনপিকে আস্থায় নেওয়া এবং তাদের এ সংক্রান্ত সংলাপ ও সর্বদলীয় উদ্যোগের আহ্বানকে মূল্য দিয়ে ত্বরিত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। অব্যাহত দোষারোপের রাজনীতি ও বিভেদের ভেদরেখা গভীর এই জাতীয় সংকটকে আরও ঘনীভূত করবে, জাতির সামনে দিন দিন বিপদ আরও বাড়বে। বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ প্রতিপক্ষকে রাজনীতিকভাবে ঘায়েল করার একটা ‘রাজনৈতিক খেলা’ বলে ধরে নিলেও ‘ফাহিমের জন্য খালেদার মায়াকান্না কেন’ বক্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। ফাহিম অপরাধী তাতে কোনো সন্দেহ নেই, হতে পারে তার জঙ্গি সংশ্লিষ্টতাও আছে। বেগম জিয়ার জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা থাকলে তো ফাহিম ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা যাওয়ায় তার তো খুশি হওয়ার কথা এই কারণে যে, অধ্যাপক রিপন চক্রবর্তী হত্যা প্রচেষ্টার নেপথ্য নায়কদের সম্পর্কে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কোনো তথ্য পাবে না। বরং উল্টো এই ব্যাখ্যা হতে পারে যে, ঘটনার প্রকৃত নায়কদের তথ্য গোপন রাখার জন্যই ফাহিমকে মেরে ফেলা হয়েছে। নেপথ্য নায়করা যদি বেগম জিয়ার কথিত পৃষ্ঠপোষকতাধন্য ‘জঙ্গি চক্রের’ লোক হয়, তাদের চিহ্নিত করে দিলেই তো সরকার পক্ষের অভিযোগ প্রতিষ্ঠিত হতো। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এমন একটি সুযোগ হাতছাড়া করল কেন? প্রশ্নটি আসে যে, তাহলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীই কি চায়নি যে এ হত্যা প্রচেষ্টার সঙ্গে জড়িত মূল নায়কদের চেহারা উন্মোচিত হোক। অর্থাৎ নেপথ্য নায়করা যাতে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়, সে জন্য ফাহিম ‘হত্যাকাণ্ড’ বা ‘বন্ধুকযুদ্ধের’ অবতারণা। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যটি মনে হয় প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে না গিয়ে বেগম জিয়ার পক্ষেই চলে গেছে। ফাহিম অপরাধী হলেও তার বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড আমাদের দেশের প্রচলিত আইনও সমর্থন করে না। বিচারবহির্ভূত যে কোনো হত্যাকাণ্ডই আইনের চোখে অচল। সরকারি-বেসরকারি কোনো মহল থেকে এমন কোনো বক্তব্য আসা উচিত নয়, যা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের যৌক্তিকতা প্রমাণে চেষ্টা বলে মনে হতে পারে। তাতে আইনের হাতকে খুব ‘খাটো’ মনে হতে পারে এবং এসবের যারা চর্চা করে লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব বলে ভাবেন, তারা আরও আশকারা পেয়ে বসেন। আশা করি ফাহিম হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী নিজে আরেকটু খতিয়ে দেখবেন এই কারণে যে, বেগম খালেদা জিয়া বা তার দল অথবা অন্য কেউ এ কথা যাতে বলতে না পারে যে, একজন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত অধ্যাপককে হত্যা প্রচেষ্টার সঙ্গে সরকারি দলের কোনো লোকই জড়িত এবং তাকে প্রোটেকশন দেওয়ার জন্য ফাহিমকে ‘বন্দুকযুদ্ধের’ বলি করা হয়েছে।
একদা ক্রসফায়ার এখন ‘বন্দুকযুদ্ধ’। এ নিয়ে বিতর্ক নতুন নয়। এ ব্যাপারে যেসব তথ্য প্রচার করা হয় তা মানুষ বিশ্বাস করতে চায় না। একজন আসামি যত দুর্র্ধষই হোক, বন্দী দশায় র্যাব-পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার সুযোগ তার থাকে না বললেই চলে। বন্দীকে নিয়ে ‘অস্ত্র উদ্ধার’ বা অন্য কোনো অভিযানে যওয়ার প্রাক্কালে বন্দী ব্যক্তির তো তার অনুসারীদের কাছে বার্তা দেওয়া সম্ভব নয় যে, ‘আমাকে নিয়ে অমুক জায়গায় অভিযানে আসছে, তোমরা প্রস্তুত থেকো।’ ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ধৃত আসামি ছাড়া আর কাউকে তো মারা যেতে খুব একটা শোনা যায় না। ‘যুদ্ধ’টা কার সঙ্গে হয়? এ প্রশ্নগুলো আছে, থাকবে। জঙ্গি হোক, খুনি ধর্ষক বা যত বড় অপরাধীই হোক আইনি প্রক্রিয়ায় যথাযথ বিচারের মাধ্যমে অপরাধীর বিচার ও শাস্তি হওয়া উচিত— শাস্তি মৃত্যুদণ্ডও হতে পারে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড আমাদের দেশের সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদ এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। কিন্তু তা থামছে না। রাজনৈতিক দল, মানবাধিকার সংগঠন ও নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে ২০০৪ সাল থেকেই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিচারবিভাগীয় তদন্তের দাবি তোলা হচ্ছে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড শুধু এই সরকারের আমলেই হচ্ছে তা নয়। উল্লেখযোগ্য হারে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড বাড়তে থাকে ২০০৪ সাল থেকে। তখন বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায়, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) গঠিত হয় সে বছরই। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি তখনো খুব খারাপ ছিল। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের কথা বলেই এলিট ফোর্সটি গঠন করা হয় এবং তারা প্রথম অপারেশনে নামে ‘ক্লিটহার্ট’ নামে। তাতে অনেক বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটে। নিজ দলের অনেক লোককেও ‘বলি’ দেওয়া হয় সুনাম কুড়োনোর উদ্দেশ্যে— এমন অভিযোগ এখনো করে থাকেন নিহতের স্বজনরা। তখন নাম ছিল ক্রসফায়ার, এখন যাকে বলা হচ্ছে ‘বন্দুকযুদ্ধ’। মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের এক তথ্য অনুযায়ী ২০০৪ থেকে ২০১৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত এমন হত্যাকাণ্ডের পরিমাণ ১৬৩৫। তাদের তথ্যানুযায়ী ২০০৪ সালে এই ধরনের হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা ছিল ১৬৬। ২০০৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৪০ জনে। এরপর ২০০৬ সালে ২৯০ জন, ২০০৭ সালে ১৩০ জন, ২০০৮ সালে ১৩৬ জন, ২০০৯ সালে ১২৯ জন, ২০১০ সালে ১০১ জন, ২০১১ সালে ৬৫ জন, ২০১২ সালে ৫৩ জন, ২০১৪ সালে ১১৯ জন এবং ২০১৫ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত ৫৯ জন। এই বছরের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বর্তমান সরকারের আমল থেকে বিএনপি-জামায়াত জামানায় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে বেশি। ২০০৪ সালের ২৬ জুন শীর্ষ সন্ত্রাসী পিচ্চি হান্নানকে দিয়ে ‘ক্রসফায়ারের’ যাত্রা শুরু হয় বলে রেকর্ড সাক্ষ্য দেয়। বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তখন বিরোধী দলে। তারা ‘ক্রয়ফায়ারের’ প্রচণ্ড বিরোধী ছিল তখন। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ‘অপারেশন ক্লিনহার্টে’ বিএনপির ছাত্রদল, যুবদল এবং অন্যান্য অঙ্গ দলের অনেকে ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হলেও জামায়াত-শিবিরের লোকজনকে সেই ‘আজাবের’ মধ্যে তেমন পড়তে হয়নি। এটাও উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, তখন থেকেই বিএনপির গর্বের সংগঠন ছাত্রদল হীনবল হতে শুরু করে এবং ছাত্রদল-যুবদলের নেতা-কর্মীরা দলের জন্য কোনো রাজনৈতিক ঝুঁকি নিতে উদ্যম হারিয়ে ফেলে। বিএনপি এখন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে কথা বলছে। এটা ভালো কথা। কিন্তু এ বিষয়ে তাদের অতীতও তো ভালো নয়। ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ব্যাপারে বর্তমান সরকারের অবস্থান নিয়ে মানুষের মধ্যে সমালোচনা আছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ ব্যাপারে যেসব কথাবার্তা বলেন, বিএনপি-জামায়াত আমলের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী এবং বাহিনীর দায়িত্বশীলদের কথাবার্তার মধ্যে কোনো পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যাবে না। তারা বলেন, আক্রান্ত হলেই নাকি বাহিনীর লোকেরা গুলি ছোড়ে। কখনই এই কথাগুলো বিশ্বাসযোগ্য করা যায়নি। ক্রসফায়ার বলুন আর ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বলুন, গণতন্ত্রে ও আইনের শাসনে কোনোভাবেই তা সমর্থনযোগ্য নয়। রাষ্ট্রশক্তির চেয়ে কোনো জঙ্গিশক্তি বা দুর্বৃত্তশক্তি অধিকতর শক্তিশালী নয়। আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও এখনো অনেক প্রশিক্ষিত, দক্ষ এবং ওয়েল ইকুইপড’। তাদের অনেক সাফল্যগাথাও আছে। তারা স্বাধীনভাবে তাদের প্রফেশনাল স্কিল ব্যবহার করতে পারলে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ ছাড়াই তারা অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সক্ষমতার পরিচয় দিতে পারে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সে স্বাধীনতা কতটুকু ভোগ করতে পারে তা নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন আছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ক্ষমতাসীনরা (যে যখন ক্ষমতায় থাকছেন) দলীয় বাহিনীর মতো বিবেচনা করে কাজে লাগান বলে অভিযোগটা বেশ জোরালো। ফলে দলবাজ, সরকারগুলোর দলবাজির অভিশাপ তাদেরও স্পর্শ করে। তখন ‘পুলিশ শাসন’ আইনের শাসনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। অতীতে যা হয়েছে, এখনো যা হচ্ছে তাতে জনশান্তি ও জনস্বার্থ নিশ্চিত হচ্ছে না।
টার্গেট কিলিং এবং জঙ্গি তৎপরতা সব মানুষের মনেই ভয় ও আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। সরকারি দলের লোকজনও শান্তিতে নেই, স্বস্তিতে নেই। তাদের মধ্যেও ভয় কাজ করছে। ভয়, আতঙ্ক, অনিশ্চয়তার মধ্যে থেকে একটি জাতি সমৃদ্ধির সড়কে গতিময় যাত্রা অব্যাহত রাখতে পারে না। দেশটা আওয়ামী লীগেরও নয় বিএনপিরও নয়। এ দেশ ১৬ কোটি মানুষের। রাজনীতিবিদদের সব কাজই হওয়ার কথা জনগণ ও রাষ্ট্রের কল্যাণে। জঙ্গি তৎপরতার মুখে রাষ্ট্র এখন সংকটে। রাষ্ট্র জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধানে নিজের সক্ষমতা স্পষ্ট করতে পারছে না। সমগ্র জনগণ ঐক্যবদ্ধভাবে রাষ্ট্রের পক্ষে না দাঁড়ালে রাষ্ট্র প্রয়োজনীয় শক্তি আহরণ করবেই বা কোত্থেকে?
জনগণ স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে না, জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে হয়। এই ঐক্যবদ্ধ করার দায়িত্বটা রাজনৈতিক নেতৃত্বের। আওয়ামী লীগ-বিএনপি এ ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছলে অন্যান্য রাজনৈতিক দল, গোষ্ঠী, ব্যক্তি ও শক্তি ঐক্যবদ্ধ হবে এটা স্বতঃসিদ্ধ। কেউ কেউ বলেন, বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ, সুশীল সমাজ উদ্যোগ নিলে জনগণ ঐক্যবদ্ধ হতে পারে। আমাদের জনসমাজ লীগ-বিএনপি দুভাগে এমন বিভক্ত হয়ে গেছে যে, দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের ঐক্য ছাড়া অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও সমগ্র জনগণের ঐক্য বিলাসী কল্পনা হতে পারে, বাস্তব হবে না। বিএনপি এ ব্যাপারে ‘বল’ আওয়ামী লীগের কোর্টে পাঠিয়ে দিয়েছে। আওয়ামী লীগ এখন রেসপনসিভ না হলে দায় যাবে আওয়ামী লীগের কাঁধে। জঙ্গি ইস্যুতে বিএনপি তো ঐক্য ও সমঝোতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, আওয়ামী লীগ কি হাত বাড়াবে না?
এ লেখা যখন শেষ করেছি, ঠিক তখন টেলিভিশনের পর্দায় ভেসে উঠে ১ জুলাই রাতে গুলশানের ৭৯ নম্বর সড়কের ‘হলি অর্টিজান বেকারি’ নামক রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলার ভয়াবহ চিত্র। সন্ত্রাসীরা রেস্তোরাঁর ভিতরে থাকা দেশি-বিদেশি নাগরিকদের জিম্মি করে। উদ্ধার অভিযানে পুলিশের দুজন সাহসী কর্মকর্তা ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলাম ও বনানী থানার ওসি সালাহউদ্দিন নিহত হয়েছেন অপারেশন শুরুর প্রথম দিকেই। শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনী জিম্মি উদ্ধার অভিযান শুরু করে ২ জুলাই সকাল ৭.৪০ ঘটিকায়। সকাল সাড়ে ১০টায় অভিযান শেষ হওয়ার আভাস পাওয়া যায়। তখন পর্যন্ত পুলিশের দুই কর্মকর্তা ছাড়া ২০ জন নিহত হওয়ার খবর দিয়েছে মিডিয়া। সবার পরিচয় কিন্তু দিতে পারেনি। এ লেখা পাঠকরা যখন পড়বেন তখন সবকিছুই পরিষ্কার হয়ে যাবে কী ঘটেছে সে রেস্তোরাঁয়। আইএসপিআর বলেছে জিম্মি ঘটনায় ২০ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। তবে এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, হামলাকারীরা রাষ্ট্রশক্তিকেই আবার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিল। মাত্র ক’দিন আগে সমাপ্ত সপ্তাহব্যাপী জঙ্গি-বিরোধী অভিযানে ১৩ হাজার লোককে গ্রেফতার করেও যে কাজের কাজটি সম্পন্ন করা যায়নি তা বোঝা গেল। আসলে রাজনৈতিক কমিটমেন্ট, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এবং সমন্বিত-সম্মিলিত রাজনৈতিক উদ্যোগের মাধ্যমে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদবিরোধী একটি জাতীয় জাগরণ ছাড়া পরিস্থিতির মূলোৎপাটন সম্ভব নয়। পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। তারা চেষ্টা তো করছে, প্রাণও দিচ্ছে। রাজনীতিবিদরা বক্তৃতাবাজি ছাড়া একে অপরের ওপর দোষ চাপানো ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বিভ্রান্ত করা ছাড়া আশাজাগানিয়া কী এমন করছেন তা দৃশ্যমান নয়। আশা করি, গুলশান ট্র্যাজেডির পর প্রধান রাজনৈতিক পক্ষসমূহ হুঁশে আসবে এবং নিজেদের করণীয় নির্ধারণ করবে। দেশি-বিদেশি জনগণের জানমালের নিরাপত্তাহীনতার উদ্বেগ আরও বেড়ে গেল। রাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে নিশ্চুপ থাকতে পারে না। তবে রাষ্ট্রের জেগে ওঠা যেন লক্ষ্যভেদী হয় পক্ষপাতদুষ্ট না হয়। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা ক্ষমতাকেন্দ্রিক দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে যেন ব্লেম গেমে জড়িয়ে না পড়েন। বাংলাদেশ প্রতিদিন
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।