আবুল কালাম আজাদ:‘সাংবাদিকতায় শেখার কোনো শেষ নেই। পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারকে ১৫ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের ঘটনায় গণমাধ্যম আর সামাজিক মাধ্যমে যা হলো, তা আমাদের বড় একটা ঝাঁকুনি দিলো, শিক্ষা দিলো। কিন্তু প্রশ্ন হলো, শিক্ষাটা কি আমরা নেবো? নাকি আবারও কোনো ইভেন্ট এলে, সুযোগ পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়বো মানুষের চরিত্র হননে?’
গত শনিবার রাতে ফেসবুকে এই স্ট্যাটাস দিয়ে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। সকালে উঠে দেখি নোটিফিকেশনে সয়লাব। শতাধিক মন্তব্যে আমাদের মানে সাংবাদিকদের তুলোধুনো করা হয়েছে। সাংঘাতিক, ধান্দাবাজ, হলুদ, সুশীল, টাউট, মূর্খ, অশিক্ষিত- হেন কোনো বিশেষণ বাকি নেই ডিকশেনারিতে। আমি কারও মন্তব্যেরই প্রতিবাদ করিনি। লজ্জায় মাথানত করে রেখেছি। তবে ভাববেন না আমি সবগুলো গালি মেনে নিয়েছি। কোনো কোনো সাংবাদিকের জন্য এই বিশেষণগুলো হয়তো ঠিক, তবে সবার জন্য নয়। কিন্তু বাবুল আক্তারের ঘটনার পর থেকে সামাজিক মাধ্যমে ঢালাওভাবে সাংবাদিক সমাজকে ধোলাই করা হচ্ছে। তবে আমি যদি একটু উল্টো করে দেখি। বাংলাদেশে এখন ২৬টি টেলিভিশন, গোটা পঞ্চাশেক রেডিও, শ’খানেক পত্রিকা, হাজারখানেক অনলাইন আছে। বাবুল আক্তারকে নিয়ে গল্পটা সবাই শুনেছেন। কিন্তু ‘বিশ্বস্ত সূত্র’এর বরাত দিয়ে রিপোর্ট করেছে হাতেগোনা কয়েকটি গণমাধ্যম। বেশির ভাগ সাংবাদিক ও গণমাধ্যম যে নজিরবিহীন সংযম দেখিয়েছে, তাতে আমি অভিভূত ও আশ্বস্ত। না, সবাই যতই গালিগালাজ করুক, আমাদের পেশার বস্তুনিষ্ঠতা ও এথিক্স এখনও ফুরিয়ে যায়নি। বেশিরভাগই এমন একটি রসালো গল্প পেয়েও ধৈর্য্য ধরে সত্যের জন্য অপেক্ষা করেছে, যেটা দারুণ প্রশংসার। যারা সংযম দেখাতে পারেননি, তাদেরও খেসারত দিতে হবে। একদিনের হিট নয়। টেকসই হিট পেতে হলে বস্তুনিষ্ঠ হতেই হবে।
আমার স্ট্যাটাসে একটা প্রশ্ন ছিল, এই ঘটনা থেকে আমরা শিক্ষা নেবো কিনা? আমার ধারণা নেবো না। ইতিহাসের শিক্ষা হলো, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না। অতীতে এমন শিক্ষামূলক ঘটনা অনেক ঘটেছে, আমরা শিক্ষা নিইনি। এমনকি প্রিয় সহকর্মী সাগর-রুনীও আমাদের নোংরা কলম থেকে রক্ষা পায়নি, তাদেরও মরণোত্তর চরিত্র হনন করেছি, এই আমরাই। তাই আমি নিশ্চিত, আবার এ ধরনের ঘটনা ঘটলে আবারও কেউ না কেউ এ ধরনের নিউজ করবে। আশার কথা হলো সংখ্যাটা কমছে, ভবিষ্যতে হয়তো আরও কমবে।
সংখ্যায় অল্প হলেও, এবার সাংবাদিকদের পদস্খলনে উস্কানি দিয়েছে পুলিশের বে-আক্কেলেপনা। কেউ ভাববেন না, আমি আমাদের ভুলটাকে জাস্টিফাই করছি বা আমাদের ভুলের দায়, পুলিশের উপর চাপাতে চাইছি। নিজেদের ভুল স্বীকার করেও বলছি, আসলেই বাবুল আক্তারের ১৫ ঘণ্টার জিজ্ঞাসাবাদের নাটকে প্রমাণিত হয়েছে পুলিশের বুদ্ধি মাথায় থাকে না। শুক্রবার সন্ধ্যায় পুলিশ অফিসার্স মেসে ২৪তম বিসিএস ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশন মিতুর স্মরণে এক শোকসভা ও ইফতার পার্টির আয়েজন করে। সে আয়োজনে বাবুল আক্তার মা হারা দুই সন্তান ও পরিবারের অন্য সদস্যদেরও নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইজি, কমিশনারের সঙ্গে তার দেখাও হয়েছে। কিন্তু বাসায় ফেরার পর মধ্যরাতে মতিঝিলের ডিসি আর খিলগাঁওয়ের ওসি গিয়ে আইজির কথা বলে বাবুল আক্তারকে নিয়ে আসেন। তখন বলা হয়েছিল, তিনি ১৫ মিনিটের মধ্যে ফিরে আসবেন, কিন্তু ফিরেছেন ১৫ ঘণ্টা পর। নেয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে তার ফোন বন্ধ হয়ে যায়। তিনি আর পরিবারের সাথে যোগাযোগ করতে পারেননি। শনিবার দুপুরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলার আগে সরকার বা পুলিশের কেউ বাবুল আক্তারের অবস্থান নিয়ে কোনো কথা বলেননি। তথ্য প্রবাহে বাধা দেয়ার কারণেই গুজব ডালপালা মেলেছে দ্রুত। কোনটা সত্য আমরা এখনও জানি না। বাবুল আক্তার একজন দক্ষ পুলিশ কর্তা। স্ত্রী মিতু খুন হওয়ার পর সারাদেশের সবাই তাকে চেনেন, তার প্রতি সহানুভূতিশীল। তিনি এখনও পুলিশ সুপার পদমর্যাদায় চাকরি করছেন। ফোন করে ডাকলেই নিশ্চয়ই তিনি ছুটে যাবেন। সেখানে কেন তাকে মধ্যরাতে ডেকে নিতে হবে? কেন তাকে পরিবারের সদস্যদের সাথে যোগাযোগ করতে দেয়া হবে না। বাবুল আক্তারের সাথেই যদি পুলিশ এই আচরণ করে, তবে সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে কী হয়, একটু ভাবলেই ভয় লাগে। এ কারণেই পুলিশকে মানুষ বন্ধু মনে করে না। যদি রাতে বা সকালে পুলিশের দায়িত্বশীল কেউ বাবুল আক্তারের ব্যাপারে সাংবাদিকদের ব্রিফ করতো, তাহলে আর এই ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হতো না। আমরা চাই পুলিশ সবার সাথেই আইনানুগ আচরণ করবে। দ্রুত মিতু হত্যার রহস্য উন্মোচন করবে, দায়ীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসবে এবং সাংবাদিকদের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করবে।